‘চ্যাম্পিয়ন’- সাবিনা আপ্লুত। মারিয়া মান্দা, সানজিদারাও ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। দীর্ঘদিন নারী ফুটবল নিয়ে কাজ করা কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের গলাও ভারী। চোখ ছলছল করা এই কোচ জানালেন, ‘এর চেয়ে রাজসিক সংবর্ধনা আর হতে পারে না। আমরা সত্যিই গর্বিত, আনন্দিত। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার ভাষা আমার নেই।’ সত্যিই তাই। ছাদখোলা ‘চ্যাম্পিয়ন’ বাসে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। তাদের অভিবাদন জানাতে রাস্তার দুই পাশে হাজারো মানুষের ঢল। কারো হাতে জাতীয় পতাকা, কারো হাতে সাবিনা-কৃষ্ণাদের ছবি সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন। কেউ ছুটছেন, কেউ হাত নাড়ছেন। পাশের রাস্তায় যারা গাড়িতে ছিলেন তাদের দৃষ্টিও ছিল সাবিনাদের দিকে। চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবিনা খাতুন। মারিয়া, কৃষ্ণা, মাসুরা, সানজিদা, মনিকারা দর্শকদের আবেগ ও ভালোবাসার জবাব দিচ্ছেন হাত নেড়ে। এ এক চোখ জুড়ানো দৃশ্য। বিমানবন্দর থেকে সাবিনাদের গাড়ি বের হওয়ার পর থেকে পথজুড়ে ছিল এ দৃশ্য।
ইউরোপিয়ান ফুটবলে দৃশ্যটা দেখা যায়। শিরোপা জয়ের পর ছাদখোলা বাসে শোভাযাত্রায় বের হয় দল। রাস্তার চারপাশে সমর্থক জড়ো হয়ে শুভেচ্ছা জানান খেলোয়াড়দের। নেপালের সঙ্গে ফাইনালের আগে নারী ফুটবল দলের স্ট্রাইকার কৃষ্ণা রানী ফেসবুকে এমনই এক ছাদখোলা বাসে শিরোপা উদ্যাপনের একটি ছবি পোস্ট করে লেখেন- ‘এমন মুহূর্তের অপেক্ষায়।’ সকালে একই আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন উইঙ্গার সানজিদা আখতার। তাদের দুইজনের ফেসবুক পোস্টে আলোড়ন সৃষ্টি হয় পুরো বাংলাদেশে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় দাবি ওঠে ছাদখোলা বাসের। মাত্র একদিনের মধ্যেই ছাদখোলা বাসের ব্যবস্থা করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। বাসটি কাল দুপুরে বিমানবন্দরে হাজির হওয়ার আগেই ভক্ত-সমর্থকরা ভিড় শুরু করে। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিড় আরও বাড়তে থাকে। সময়ের সঙ্গে জনস্রোত রূপ নেয় জোয়ারে। হাতে হাতে পতাকা ও ব্যানার, কণ্ঠে স্ল্লোগান। সুসজ্জিত ব্যান্ড দল বাজাতে থাকে ‘জয় বাংলার, বাংলার জয়।’ বিমানবন্দরের ভেতরে তখন জয়ের গৌরব নিয়ে দেশে ফেরা নারী ফুটবল দলের প্রতেককে স্বাগত জানানো হচ্ছে ফুলের মালায়।
নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ইতিহাস গড়া সাফল্য নিয়ে বাংলাদেশ দল কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় পা রাখে দুপুর দুইটার একটু আগে। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, বাফুফের দুই সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া ও মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ ও অন্য কর্তারা বরণ করে নেন সাবিনা-মারিয়া-কৃষ্ণাদের। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরুতেই কেক কাটা হয়। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী কেক তুলে দেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের মুখে। শিরোপাজয়ী অধিনায়কই শুধু নন, তিনি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোল স্কোরারও। কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনকেও কেক খাইয়ে দেওয়া হয়। ক্রীড়ামন্ত্রী এরপর একে একে দলের প্রত্যেক খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের গলায় পরিয়ে দেন ফুলের মালা। একটু পর দু’হাতে ট্রফি উঁচিয়ে চওড়া হাসিতে এগিয়ে যান অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। তাকে অনুসরণ করে গোটা দল। সেখানে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন- সাবিনা খাতুন। প্রথমবারের মতো জেতা সাফের শিরোপাকে দেশের সকল মানুষের অর্জন হিসেবে উল্লেখ করে সাবিনা বলেন, ‘আমাদেরকে এত সুন্দরভাবে বরণ করে নেওয়ার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
এখানে আমাদের মন্ত্রী মহোদয় আছেন, ফেডারেশনের কর্মকর্তারা আছেন তাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের মেয়েদের, বাংলাদেশের ফুটবলকে আপনারা যে এত ভালোবাসেন, সেজন্য আমরা অনেক অনেক অনেক গর্বিত। সকলকে ধন্যবাদ। সকলে আমাদের জন্য দোয়া করবেন। এই ট্রফি বাংলাদেশের ১৬ কোটি বলুন, ১৮ কোটি বলুন বা ২০ কোটি বলুন, এই সকল মানুষের।’ আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতা সাবিনা আরও এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়ে বলেন, ‘আমরা একটা ভালো ফল করে এসেছি। আমাদের এখন চিন্তা হচ্ছে সামনের দিকে কীভাবে আরও এগিয়ে যাওয়া যায়।’ বিমানবন্দরের বাইরে তখন অপেক্ষায় হাজারও মানুষ। অনেকের হাতেই জাতীয় পতাকা, নানা রকম ব্যানার। বিকেএসপি’র একটি বড় দলও দেখা যায় সেখানে লাইন ধরে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মেয়েদেরকে বরণ করে নিতে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত চারপাশ। বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষায় মেয়েদের সেই স্বপ্নযাত্রার বাহন, ‘ছাদখোলা বাস।’ সেই বাসে ওঠার সময়ও মেয়েদের আবার ফুল ছিটিয়ে অভিনন্দন জানানো হয়। বিমানবন্দর থেকে কাকলী, জাহাঙ্গীর গেট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে বিজয় সরণি। সেখান থেকে তেজগাঁও, মৌচাক, কাকরাইল, আরামবাগ, মতিঝিল শাপলা চত্বর হয়ে বাফুফে ভবনে প্রবেশ করে বাসটি। বিমানবন্দর থেকে মতিঝিলে বাফুফে ভবনে আসতে গাড়িটির সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। প্রায় প্রতিটি সড়কেই মেয়েদের স্বাগত জানিয়েছে জনতা।
চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের স্বাগত জানাতে বনানী কাকলী ওভারব্রিজের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ জাফর ইকবাল। মাছরাঙা টেলিভিশনের সামনে সাংবাদিকদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সাত রাস্তায় পতাকা জড়িয়ে সহকর্মীদের নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সাংবাদিক মুন্নী সাহা। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ল্লোগান দিতে দেখা গেছে- ‘জয় জয় হলো জয়, বাঘিনীদের হলো জয়’, ‘বাঘিনীদের গর্জন শিরোপা অর্জন’। জনতার স্রোত ছিল বাফুফে ভবনেও। ব্যানার ফেস্টুন ফুল নিয়ে ফুটবল ভবনের সামনে আসেন হাজার হাজার মানুষ। বাফুফে ভবনে মেয়েদেরকে বরণ করে নেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ও সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী। শুরুতে মেয়েদের ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান সভাপতি। তারপর সেখানে ছিল রিফ্রেশমেন্ট, ছিল ফটোসেশন। বাঘিনীদের শুভেচ্ছা জানাতে উপস্থিত ছিলেন অনূর্ধ্ব ১৫ দলের সদস্যরাও। কাঠমান্ডু থেকে ফেরার পথে ফ্লাইটেও এক দফায় উদ্যাপন হয়। সেখানে বাংলাদেশ বিমানের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হয় দলকে। সাবেক জাতীয় দলের ক্রিকেটার ও বিমানের ক্রু সানোয়ার হোসেন মিষ্টিমুখ করান মেয়েদের। কেক কাটার পর্ব ছিল বিমানেও।
আপনার মতামত লিখুন :