সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গতকাল শুক্রবার প্রতীক বরাদ্দ পেয়েই সরাসরি আনুষ্ঠানিক প্রচারে মাঠে নেমে গেছেন প্রার্থীরা। মসজিদে জুমার নামাজ আদায়ের পর প্রার্থীরা মুসল্লিদের কাছে প্রচারপত্র বিলি করেন। স্লোগান, মিছিল, মাইকে প্রচার, নির্বাচনী ক্যাম্প উদ্বোধন—এসব কর্মকাণ্ডে দুই নগরজুড়ে নির্বাচনে বাড়তি আমেজ যোগ হয়। কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার অভিযোগও পাওয়া যায়।
সিলেটে আনুষ্ঠানিক প্রচারের প্রথম দিনেই জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থীর প্রচারে হামলা এবং এ ঘটনায় একজন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে অভিযোগ করা হয়। রাজশাহীতে দুপুরে প্রচার শুরুতে বাধা হয় প্রখর রোদ্দুর।
সিলেটে যেভাবে প্রচার :
সিলেটে রিটার্নিং অফিসার ফয়সল কাদের গতকাল সকাল থেকে প্রতীক বরাদ্দ দিতে শুরু করেন। সিলেট সিটি করপোরেশনে (সিসিক) মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
তাঁদের মধ্যে চারজন দলীয় প্রার্থী। বাকি তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে যথারীতি আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নৌকা প্রতীক, জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. নজরুল ইসলাম বাবুল লাঙল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা মাহমুদুল হাসান হাতপাখা এবং জাকের পার্টির প্রার্থী মো. জহিরুল আলম গোলাপ ফুল প্রতীক পেয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে মোহাম্মদ আবদুল হানিফ কুটু ঘোড়া, মো. ছালাহ উদ্দিন রিমন ক্রিকেট ব্যাট এবং মো. শাহজাহান মিয়া বাস গাড়ি প্রতীক পেয়েছেন।
নগরের মেন্দিবাগ এলাকায় রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে সকাল সাড়ে ৭টায় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী এবং তাঁদের কর্মী-সমর্থকরা জড়ো হতে থাকেন। প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর কাউন্সিলর প্রার্থীরা দ্রুত প্রতীকের রেপ্লিকা তৈরি করে জুমার নামাজের পরপরই প্রচারে নেমে পড়েন। অনেকে গতকাল নির্বাচনী কার্যালয়েরও উদ্বোধন করেন।
প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আচরণবিধি মেনেই নির্বাচনের প্রচার চালাব। আমার প্রতীক নৌকা দেশের উন্নয়নের প্রতীক।
সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার প্রায় পাঁচ লাখ ভোটার নৌকায় ভোট দিয়ে আমাকে জয়ী করবেন বলে আমি আশাবাদী।’
আনোরুজ্জামান গতকাল প্রথমে নগরের মেন্দিবাগ ও উপশহর এলাকায় প্রচার শুরু করেন। এ সময় তিনি পথচারী, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সিসিকের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের শেখঘাট জামে মসজিদের মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের মধুশহীদ জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন এবং সেখানে নামাজ শেষে মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে নির্বাচনে তাঁদের সমর্থন চান। সন্ধ্যা ৭টায় নগরের মির্জাজাঙ্গাল এলাকায় হোটেল নির্ভানা ইনে তাঁর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ের উদ্বোধন করা হয়। রাতে মৌলভীবাজার সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় এবং ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে উঠান বৈঠক করার কথা ছিল আনোরুজ্জামানের।
জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী মো. নজরুল ইসলাম বাবুল গতকাল দুপুরে নগরের কোর্ট পয়েন্ট এলাকার কালেক্টরেট মসজিদে জুমার নামাজ আদায় শেষে মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন এবং তাঁদের দোয়া ও সমর্থন চান। পরে রাত ৮টার দিকে নগরের কুমারপাড়া এলাকায় তাঁর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় উদ্বোধন কর হয়। এরপর রাত ৯টায় নজরুল ইসলাম বাবুল কুমারপাড়া পয়েন্টে স্থানীয়দের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। লাঙল প্রতীককে যে মানুষ এখনো ভালোবাসে সেটা টের পাচ্ছি। তা ছাড়া মানুষ কিছুটা বিরক্ত হয়ে এখন পরিবর্তন চায়। রিকশাচালক, হকার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ আমার লাঙল প্রতীকে ভোট দেবে জানিয়েছে।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলদেশের প্রার্থী মাওলানা মাহমুদুল হাসান প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে প্রথমে নিজ এলাকা ২১ নম্বর ওয়ার্ডের শিবগঞ্জ সোনারপাড়ায় জনসংযোগ করেন। এরপর সোনারপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় ও প্রচারপত্র বিলি করেন। এরপর নগরের ২২ নম্বর ওয়ার্ড ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেন। রাতে আবারও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে জনসংযোগ করেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আশাব্যঞ্জক সাড়া পাচ্ছি। মানুষ পরিবর্তন চাচ্ছে। আগের সবাই পরীক্ষায় কেউ উত্তীর্ণ হয়েছে, কেউ ব্যর্থ হয়েছে। মানুষের কাছে সব ফলাফল আছে। তারা আমাদের গ্রহণ করতে চাচ্ছে।’
জাতীয় পার্টির প্রচারপত্র বিলির সময় হামলার অভিযোগ :
গতকাল প্রচারপত্র বিলির সময় জাতীয় পার্টির এক সমর্থকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। সিলেট মহানগর জাতীয় পার্টির সদস্যসচিব আব্দুস শহিদ লস্কর বশিরের অভিযোগ, ‘জুমার নামাজের পর জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীর লিফলেট বিতরণের সময় ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সরুজ মিয়া প্রথমে বাধা দেন। পরে যুবলীগ নেতা শামীম গ্রুপের অনুসারী তুষারের নেতৃত্বে মেয়র প্রার্থী বাবুলের সমর্থক রাইয়ান আহমদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আহত রাইয়ান আহমদ বলেন, ‘লিফলেট বিতরণের সময় তুষারের নেতৃত্বে ১০-১২ জন এসে আমার ওপর হামলা চালিয়ে আমার মোবাইল ফোন, নগদ টাকা, লিফলেট ছিনিয়ে নিয়ে যান। এ সময় তাঁরা আমাকে মারধরও করেন। পরে স্থানীয়রা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনায় গঠিত মিডিয়া সেলের সদস্যসচিব ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর সঙ্গে আমাদের সাংগঠনিকভাবে দায়িত্বশীল কেউ যুক্ত নন। প্রশাসন বিষয়টি দেখুক। এভাবে নির্বাচনী প্রচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীকে আমরা কোনোভাবে প্রশ্রয় দেব না।’
রাজশাহীতে দ্রুত প্রচার শুরুতে বাধা হয় প্রখর রোদ্দুর :
রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে প্রতীক বরাদ্দ করেন নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মো. দেলোয়ার হোসেন। সকালে প্রথমে সাধারণ ওয়ার্ড ও সংরক্ষিত নারী আসনের প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করা হয়। প্রতীক পেতে প্রার্থীরা তাঁদের সমর্থকদের মিছিল নিয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে হাজির হন।
সবার শেষে প্রতীক বরাদ্দ করা হয় মেয়র প্রার্থীদের। প্রতীক পাওয়ার পরপরই আনুষ্ঠানিক প্রচারে বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রখর রোদ্দুর। প্রার্থীরা বিকেল হতে না হতেই বেরিয়ে পড়েন ভোট প্রার্থনায়। বিকেল ৫টার দিকে নগরের কাশিয়াডাঙ্গা এলাকা থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুরশিদ আলম ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপনও পৃথকভাবে প্রচার শুরু করেন নগরীর বিভিন্ন এলাকায়।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে রাজশাহীকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তিলোত্তমা রাজশাহী গড়তে আমার অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করতে আরকেবার মেয়র হতে চাই আমি। এবার জনগণের মাঝেও ব্যাপক সাড়া রয়েছে। আশা করি নৌকার জয় হবেই।’
ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুরশিদ আলম বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ ভালো আছে। নির্বাচন কমিশন আশ্বাস দিয়েছে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। আমরাও আশাবাদী। কিন্তু ইভিএমের ব্যাপারে আমাদের আস্থাও আছে, শঙ্কাও আছে। শঙ্কা হলো—এক জায়গায় ভোট দিলে আরেক জায়গায় চলে যায়। তারপরও আমি জয়ী হব বলে আশাবাদী।’
জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন বলেন, ‘অনেকেই আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। আমরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করব না। আমরা জনগণের ভোট নিয়ে বিজয়ী হতে চাই। রাজশাহীতে জাতীয় পার্টিকে আবারও উজ্জীবিত ও নগরকে ঢেলে সাজাতে চাই উন্নয়ন দিয়ে।’
রিটার্নিং অফিসার মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রার্থীদের আচরণবিধি প্রতিপালনের জন্য ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সহকারী রিটার্নিং অফিসাররাও দেখছেন। সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমরা কাজ করছি।’
আপনার মতামত লিখুন :