দখল-দূষণে বিপন্ন বাংলাদেশের জলাভূমি


hadayet প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ২, ২০২৩, ৪:০৮ পূর্বাহ্ন / ৪১
দখল-দূষণে বিপন্ন বাংলাদেশের জলাভূমি

জীবন ও জীববৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য উপাদান জলাভূমি। অথচ শিল্প বিপ্লবের পর থেকে দেশে দেশে জলাভূমিগুলো হারাতে বসেছে কেবলই দখল আর দূষণে। এরই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রাণ-প্রকৃতির ওপর; যা বিশ্বজুড়ে দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশও তার জলাভূমিগুলো রক্ষা করতে পারছে না। ফলে এক অনিশ্চিত অথচ অনিবার্য পরিণতির দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জলাভূমিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর প্রায় সব প্রাচীন সভ্যতা। জলাভূমি ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠে পানি সংরক্ষণ, পরিশোধন ও পানির চাহিদা পূরণ; খাদ্য উৎপাদন, মৎস্য ও জলজপ্রাণীর আশ্রয়, উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা, নদী ভাঙন, ভূমিক্ষয়, দূষণ ও বন্যা রোধ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই প্রভৃতি বহুমাত্রিক সুবিধা দেয়, যা অচিন্তনীয়।

তাই জলাভূমিগুলোকে ক্রমবর্ধমান হুমকি থেকে রক্ষার পাশাপাশি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণে প্রতিবছর ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়। অন্যান্য বছরের মতো চলতি বছরও জলাভূমি দিবস পালন করছে বাংলাদেশ। এ দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ‘সময়ের অঙ্গীকার, জলাভূমি পুনরুদ্ধার। এর অন্যতম উদ্দেশ্য জীববৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি টেকসই পরিবেশ উপহার দেয়া।

কতটা সমৃদ্ধ আমাদের জলাভূমি
সাধারণত জলাভূমি মানেই মাছের উৎস। পৃথিবীর মোট আহরিত মাছের দুই-তৃতীয়াংশই আসে জলাভূমি থেকে। পৃথিবীর মোট খাদ্য উৎপাদনের ২৪ শতাংশই জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল; যা শুধু মানুষই নয়, মাছ, পশু-পাখি, গবাদিপশু ইত্যাদি প্রাণিকূলেরও খাদ্যের উৎস। এছাড়া রান্নার জ্বালানির উৎস, সহজ ও স্বল্পব্যয়ের যোগাযোগেরমাধ্যম হিসেবেও জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম।

বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত, যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৫০ ভাগ। দেশের কৃষি, অর্থনীতি, যোগাযোগ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ইত্যাদির জন্য এসব জলাভূমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলাভূমিগুলোতে পাঁচ হাজারেরও বেশি সপুষ্পক উদ্ভিদ ও দেড় হাজারেরও বেশি মেরুদণ্ডী প্রাণীর বাস। এসব প্রাণীর মধ্যে ৭৫০ প্রজাতির পাখি, ৫০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এছাড়া ৪০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী ও ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, যাদের জীবনকালের পুরোটাই পানির ওপর নির্ভরশীল। হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশের উত্তর-পূর্বের জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনায় ৩৭৩টি হাওড় রয়েছে। মাছ এসব হাওড়ের প্রধান সম্পদ মাছ। পেশাদার জেলে ছাড়াও হাওড়ের ওপর স্থানীয় মানুষ বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল। তাছাড়া এ অঞ্চলগুলোর মাছ দেশের অন্যতম প্রাণীজ আমিষের যোগানদাতা। বর্ষাকাল হাঁস পালনে আয় এবং শুষ্ক মৌসুমে গোচারণ ভূমি স্থানীয়দের জীবিকার অন্যতম উৎস। তাই দুধ-দধির জন্যও হাওড়াঞ্চল বিখ্যাত।

সমৃদ্ধির কারণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওড়কে সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জীববিজ্ঞানীদের মতে, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। এটি ১৫০ প্রজাতির মাছের অভয়াশ্রমও। তাছাড়া হাওড়ে প্রতিবছর শীতকালে প্রায় ২০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখিসহ ২০ থেকে ২৫ লাখ পাখির আগমন ঘটে। এর পেছনে পরিবেশগত ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে।

হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, হাওড়াঞ্চলে প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ ২৫ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদিত হয়, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জলাভূমিগুলো স্থানীয়দের জীবন-জীবিকার ওপর গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যও রক্ষা করে।

দিন দিন সংকটে জলাভূমি
স্বাধীনতা লাভের পর দেশে নির্বিচার কৃষি এবং ৯০ দশকে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, সড়ক-কলকারখানা নির্মাণ, ভরাট ইত্যাদি জলাভূমিগুলোকে সংকুচিত করে ফেলেছে। এর ফলে জলাভূমি পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা যেমন ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনই বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশের ওপর। এছাড়া জলাভূমি কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে দিন দিন সুপেয় পানির সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো ভবিষ্যতে এ সংকট গুরুতর রূপ ধারণ করবে।  রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হিসেবে ঢাকায় এক সময় ২৬টি খাল ছিল। সেসব খালের প্রায় সবই দখল হয়ে গেছে, যে কয়েকটি কোনো রকমে টিকে আছে, সেগুলোও প্রায় মৃত। এছাড়া ১৯৭৮ সালে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৫২ হেক্টর, যা ২০১৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৩৫ হেক্টর। ঢাকা শহরের মতো এভাবেই সারা দেশে খাল-বিলসহ সব ধরনের জলাধার দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। এর সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে জলাধারের ওপর নির্ভরশীল কোটি মানুষের পেশা, সংস্কৃতি, মাছ, পাখি, সরীসৃপ ও উদ্ভিদসহ অসংখ্য বন্যপ্রাণী।

এ বিষয়ে কথা বলতে হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতরের সিনিয়র কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোন ও অফিস নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও কলটি রিসিভ হয়নি। এছাড়া অধিদফতরের উপপরিচালক কামাল মোহাম্মদ রাশেদ ফোন রিসিভ করলেও টেলিফোনে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

আইনগত বাধ্যবাধকতা
সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ ক-এর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন, যা সরকারের পরিবেশবান্ধব নীতির প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা যায়।’
এছাড়া পরিবেশ অধিদফতর এখন পর্যন্ত দেশের ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার প্রায় সবগুলোই জলাভূমি। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এসব এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপন, মাটি, পানি ও বায়ু দূষণকারী কার্যক্রম, মাছসহ জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপসহ যে কোনো ধরনের পরিবেশ দূষণ নিষিদ্ধ। সংবিধানসহ দেশের বিভিন্ন আইনে জলাভূমিগুলো সংরক্ষণের কথা বলা হলেও বাস্তবে এটি প্রতিফলনের তেমন কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায় না।

করণীয় কী
অস্তিত্ব সংকটে পতিত জলভূমিগুলো রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতরের জাতীয় কমিটির সদস্য ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৮ এর ক-এর অনুচ্ছেদেই জলাভূমি সংরক্ষণের কথা উল্লেখ আছে। আমাদের জলাভূমি নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটছে, তা মূলত দেশের সংবিধান এবং পরিবেশ, বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক অন্যান্য আইনের পরিপন্থি। আসলে এসব আইন না মানার কারণেই জলাভূমিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।’

‘প্রতিটি রাজনৈতিক দলই যখন সরকার গঠনের শপথ নিয়েছে, তখন তারা দেশের সংবিধান মেনে চলার শপথ নিয়েছে। তারা যদি সংবিধান মেনেই চলে, তবে নতুন করে জলাভূমি রক্ষার প্রশ্ন আসবে কেন? সেটা তো তাদেরই দায়িত্ব,’ বলেন তিনি। পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আসলে ভবিষ্যতের বিপদটা আমরা টের পাচ্ছি না। বিষয়টি বোঝার চেষ্টাও করছি না। তাই জলাভূমিগুলো দূষণ, দখল, ভরাট এবং উন্নয়নের নামে জলাভূমিগুলোকে ঘিরে অদূরদর্শী কর্মকাণ্ড চলছে। সরকারে উচিত জলাধারগুলো রক্ষার মাধ্যমে দেশের সংবিধান মানার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষিত, টেকসই পরিবেশ ও নিরাপত্তা প্রদান করা।’ বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদও মনে করেন গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি সংরক্ষণে বর্তমান পদক্ষেপের পাশাপাশি আরও অনেক কিছুই করণীয় রয়েছে।

তিনি বলেন, সুন্দরবন ও উপকূলীয় জলাভূমিগুলো বন বিভাগের দায়িত্বে। এর বাইরে শুধু টাঙ্গুয়ার হাওড়ের প্রতিবেশগত বিষয়গুলো বন বিভাগ দেখাশোনা করে। তবে এর আওতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এছাড়া এসব অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ, কলকারখানা তৈরি ও ভরাটের মতো প্রকল্পের আগে পরিবেশগত বিষয়ও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয়দের সচেতনতা খুবই জরুরি।

তিনি বলেন, সীমিত সামর্থ্যের তুলনায় বন বিভাগ জলাভূমিগুলো রক্ষায় তার সাধ্যমতো কাজ করছে। কিন্তু এর সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি বিভাগ ও অধিদফতর সম্পৃক্ত রয়েছে, যাদের একান্ত সহযোগিতা ও প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের আরও নিবিড় সমন্বয় প্রয়োজন।