বাংলাদেশের মৎস্য খাতের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নেপথ্যে, সুমিত কুমার পাল


hadayet প্রকাশের সময় : অক্টোবর ১৯, ২০২৩, ৭:৪২ পূর্বাহ্ন / ১৫৭
বাংলাদেশের মৎস্য খাতের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নেপথ্যে, সুমিত কুমার পাল

দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যমোচন ও রপ্তানি আয়ে মৎস্য খাতের অবদান আজ সর্বজনবিধিত। বিশেষত গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশ এ খাতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী এ খাতের একটি আদর্শ গ্রহণযোগ্যতা অর্জিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায়, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার “দ্যা স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ এন্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২” শিরণামের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ ৩য়, বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে ৫ম, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ক্রাস্টাসিয়া উৎপাদনে ৮ম এবং ফিনফিস উৎপাদনে ১২তম স্থান অধিকার করেছে। বিশ্বের মোট স্বাদুপানির মাছের প্রায় ১১ শতাংশ এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। তাছাড়া বিশ্বে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১ম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে ৪র্থ ও এশিয়ার মধ্যে ৩য় স্থান অধিকার করেছে। এ অর্জন অত্যন্ত গৌরব ও সম্মানের।

বাংলাদেশের মোট জিডিপি’র ৩.৫৭ শতাংশ, কৃষিজ জিডিপি’র ২৬.৫০ শতাংশ এবং মোট রপ্তানি আয়ের ১.২৪ শতাংশ মৎস্য উপখাতের অবদান। মৎস্য খাতে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৫.৭৪ শতাংশ ও মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের পরিমাণ চাহিদার (৬০ গ্রাম/দিন/জন) বিপরীতে বৃদ্ধি পেয়ে ৬২.৫৮ গ্রামে উন্নীত হয়েছে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১) । অপরদিকে, গত এক যুগের ব্যবধানে বাংলাদেশে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় দেড় গুণেরও বেশি। সরকারের মৎস্যবান্ধব কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং চাষী ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক ও লাগসই কারিগরি পরিষেবা প্রদানের ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদন করেছে ৪৭.৫৯ লক্ষ মে. টন (জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ, মৎস্য অধিদপ্তর ২০২২)।

মৎস্য ও মৎস্যপণ্য বাংলাদেশের রপ্তানির অন্যতম প্রধান খাত। বাংলাদেশ হতে প্রধানত বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি, মাছ, কাঁকড়া, কুঁচিয়া, শুঁটকি, মাছের আঁইশ, পাখনা ও ফুলকা ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপানসহ বিশ্বে প্রায় ৫০টিরও অধিক দেশে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে অর্থনৈতিক মন্দা থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যকর ও যুগোপযোগী উদ্যোগ গ্রহনের ফলে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৪ হাজার ৪২ মে. টন মৎস্য পণ্য রপ্তানি করে ৫ হাজার ১৯১ কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে যা বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ১ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং বিগত বছরের তুলনায় ২৬.৯৬ শতাংশ বেশি (জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ, মৎস্য অধিদপ্তর ২০২২)।

দেশের জলাশয়ে প্রায় ৮০০ প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি রয়েছে। এর মধ্যে ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ এবং ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ। ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। ঐতিহ্যের অংশ মিঠাপানির এসব সুস্বাদু মাছ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার্থে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা পরিচালনা করে এখন পর্যন্ত ২৪টি বিপন্ন প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া নদ-নদী, হাওর ও বিলে দেশীয় মাছের পোনা অবমুক্তকরণ ও মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ মাছের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সরকারের এরূপ কার্যকর উদ্যোগের ফলে হারিয়ে যাওয়া নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ আবার বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশেরও বেশি মানুষ মৎস্য সেক্টরের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেছে। আর্শ্চযজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার ৮০ শতাংশ কর্মীই নারী যার সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষাধিক। তাছাড়া বর্তমান সরকারের তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায় উন্নয়ন কার্যক্রমে নারীদের অগ্রাধিকার প্রদান, যাদের মাছ চাষের জমি রয়েছে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাছচাষ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে নির্বাচন করা হয়ে থাকে।

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে “জেলেদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান নির্দেশিকা ২০১৯” বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রকৃত জেলেদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক ১৬ লক্ষ ২০ হাজার জেলেদের নিবন্ধন ও ১৪ লক্ষ ২০ হাজার স্মার্ট পরিচয়পত্র প্রদান কার্যক্রম চলমান আছে। মৎস্য অধিদপ্তরের এক তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯-১০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকালীন প্রায় ৪ লক্ষ জেলে পরিবারকে প্রতি মাসে ৪০ কেজি হারে ৪,৭০,৭৪৬.৫৬ মে. টন এবং ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ জেলে পরিবারকে ২০ কেজি হারে মোট ৫২,৫৯০.১০ মে. টন ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসব সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫.৫৬ লক্ষ মে. টন ইলিশ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে এবং এটি বিগত ১০ বছরে মোট ইলিশের উৎপাদনের চেয়ে ৬৬.১৭ শতাংশ বেশি। ২০১৫ সাল থেকে সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ও সংরক্ষণের জন্য প্রতি বছর ২০ মে হতে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মোট ৬৫ দিন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জলসীমায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং এই কার্যক্রমের আওতায় ২০২১ সালে প্রায় ৩ লক্ষ জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি হারে মোট ২৫,৬৯৫.৩৭ মে. টন ভিজিএফ (চাল) বিতরণ করা হয়েছে, যা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম বড় সাফল্য।

প্রসঙ্গত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর হাত ধরে স্বাধীন বাংলাদেশে মৎস্য খাতের সমৃদ্ধির সূচনা হয়েছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমার মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইফস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি ইনশাল্লাহ, এই দিন আমাদের থাকবে না।” জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে গণভবন লেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মাছের পোনা অবমুক্ত করে মৎস্য চাষকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার শুভ সূচনা করেছিলেন।

জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে মৎস্যবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের ফলে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন আজ সফল হয়েছে; স্বাধীনতা ৪৬ বছর পর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ চাহিদার বিপরীতে মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। দেশ মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় গ্রামের সাধারণ মানুষ স্বল্পমূল্যে মাছ ও পুষ্টি পাচ্ছে। তাই মৎস্য খাত বর্তমানে দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উন্নত দেশগুলো এখন বাংলাদেশের এই সাফল্যের নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরছে, যা অবশ্যই আমাদের সকলের অহংকারের বিষয়।

সুমিত কুমার পাল

সহকারী অধ্যাপক,ফিশারিজ বিভাগ

সহকারী প্রক্টর

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,

মেলান্দহ ,জামালপুর-২০১২।