সরকারের তৎপরতায় দেশে ফিরছে এমভি আবদুল্লাহ 


hadayet প্রকাশের সময় : মে ১৩, ২০২৪, ৪:০৩ পূর্বাহ্ন / ২১
সরকারের তৎপরতায় দেশে ফিরছে এমভি আবদুল্লাহ 

নিজস্ব প্রতিবেদক

দীর্ঘ এক মাস জলদস্যুদের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন এমভি আবদুল্লাহর জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং নাবিকরা। এতো কম সময়ে ছিনতাই হওয়া জাহাজ উদ্ধারের নজির খুবই কম আছে। দস্যুদের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হওয়ায় কাজটি সহজ হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, এর আগে ২০১০ সালে একই প্রতিষ্ঠানের জাহাজ এমভি জাহান মণী উদ্ধারে সময় লেগেছিল ৯৯ দিন।

জাহাজটির স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম জানায়, রবিবার (১২ মে) সকালে জাহাজটি বঙ্গোপসাগরে দেশের জলসীমায় প্রবেশ করে। সোমবার (১৩ মে) জাহাজটি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় পৌঁছাবে। কেএসআরএম গ্রুপের এসআর শিপিংয়ের কর্মকর্তা আবদুল মুবিন বলেন, এমভি আবদুল্লাহ বর্তমানে যে গতিতে আসছে এতে সোমবার রাত ৮টার মধ্যে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় নোঙর করবে।

সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবল থেকে দীর্ঘ এক মাস পর গত ১৩ এপ্রিল স্থানীয় সময় রাত ১২টা এবং বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় মুক্তি পায় এমভি আবদুল্লাহ জাহাজসহ ২৩ নাবিক। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে, মুক্তিপণের মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হলেও, জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান এই বিষয়ে কিছু জানায়নি।

এমভি আবদুল্লাহর আগে সর্বশেষ মুক্তিপণ ছাড়াই বুলগেরিয়ার জাহাজ এমভি রুয়েনকে উদ্ধার করা হয়। এমভি রুয়েন কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনী উদ্ধার করে গত ১৬ মার্চ। তিন মাস জিম্মিদশায় ছিল জাহাজটি। এর আগে ইসরায়েলের একটি জাহাজ ছিনতাই করলেও সফল হয়নি দস্যুরা। এক দিনের মাথায় আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী জাহাজটি উদ্ধার করে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ান আর্থ ফিউচার ফাউন্ডেশন এক দশক আগে ‘ওশান্স বিয়ন্ড পাইরেসি’ প্রকল্পের আওতায় সোমালিয়া উপকূলে দস্যুতা নিয়ে সমীক্ষা চালায়। সংস্থাটির ‘দ্য ইকোনমিক কস্ট অব সোমালি পাইরেসি ২০১২’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে ৩১টি জাহাজ মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছিল। প্রতিটি জাহাজ ছাড়া পেতে গড় সময় লেগেছে ১৭৮ দিন। ২০১২ সালে আটটি জাহাজ মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে গড়ে সময় লেগেছে ৩১৬ দিন। সেই তুলনায় এমভি আবদুল্লাহ অনেক সময় ছাড়া পেয়েছে জলদস্যুদের কবল থেকে।

এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাই হওয়ার পর থেকেই সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ বলছে, এমভি জাহাজ মণি উদ্ধারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়ায় চাপে পড়ে দস্যুরাও দ্রুত জাহাজটি ছেড়ে দিয়েছে।

কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত জানান, এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাইয়ের পর প্রথম দিন থেকেই আমরা কাজ শুরু করি। নাবিকদের দ্রুত নিরাপদে ফেরানোই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। আগের অভিজ্ঞতা থাকায় দস্যুদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি সমঝোতার প্রক্রিয়াগুলোও আমরা গুছিয়ে এনেছিলাম।

তিনি আরও বলেন, সোমালিয়ার উপকূলে দস্যুতার প্রবণতা বাড়ার পর আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়ায় দস্যুরাও চাপে ছিল। সরকারও নাবিকদের উদ্ধারে আমাদের সব রকমের সহযোগিতা করেছে। এতে খুব দ্রুত সময়ে উদ্ধার সম্ভব হয়েছে।

উদ্ধারের কিছুদিন আগে ১০ এপ্রিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানান, আমরা নাবিকদের পরিবারকে আশ্বস্ত করতে চাই, সরকার সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছে। প্রথমত যারা অপহরণ করেছে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন পক্ষের মাধ্যমে আলোচনা চলছে। দ্বিতীয়ত তাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রচুর চাপ তৈরি করা হয়েছে। নাবিকরা ভালো আছেন, নিয়মিতভাবে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, এমনকি ভিডিও কলেও কথা বলছেন। সুতরাং যে উদ্বেগটা কিছুদিন আগে ছিল সেটি এই মুহূর্তে নেই। আমরা আশা করছি তাদেরকে শিগগির মুক্ত করতে পারবো।

এরপর ১৪ এপ্রিল মধ্যরাতে জাহাজটি জলদস্যুমুক্ত হয়। মুক্তির পর জাহাজটি দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেয়। ২১ এপ্রিল বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই আল হারমিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে জাহাজটি। জাহাজটিতে থাকা ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা সেখানে খালাস করা হয়। পরবর্তীতে আমিরাতের মিনা সাকার বন্দর থেকে ৫৬ হাজার মেট্রিক টন চুনা পাথর লোড করা হয়। এসব পণ্য নিয়ে দেশের পথে রওনা দেয় এমভি আবদুল্লাহ।

উদ্ধারের পর নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালি মাহমুদ চৌধুরী জানান, বিভিন্ন চাপ ছিল জলদস্যুদের উপরে। শেষ মুহূর্তে ৪ থেকে ৫ জন নাবিককে সোমালিয়ার জলদস্যুরা নিয়ে যেতে চায়। ইউরোপীয় নৌবাহিনীর তৎপরতায় তারা তা পারেনি।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘টাকা-পয়সা কিংবা মুক্তিপণের সঙ্গে আমাদের কোনো ইনভলমেন্ট নেই। টাকা দিয়ে জাহাজ ছাড়িয়ে আনা হয়েছে, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ছবি দেখাচ্ছেন, এ সব ছবির কোনো সত্যতা নেই। ছবিগুলো কোথা থেকে আসছে, কীভাবে আসছে- সেটি আমরা জানি না।’

মুক্তিপণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করেছি দীর্ঘদিন। এখানে মুক্তিপণের কোনো বিষয় নেই। ‌ আমাদের আলাপ-আলোচনা এবং বিভিন্ন ধরনের চাপ আছে। ‌ সেই চাপগুলোও এখানে কাজে দিয়েছে।’

এমভি আবদুল্লাহ গত ৪ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে কয়লা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হারমিয়া বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। এর মধ্যে ১২ মার্চ দুপুর দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুর কবলে পড়ে জাহাজটি।

এসআর শিপিংয়ের অধীনে মোট ২৪টি জাহাজের মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত করা হয় এমভি আবদুল্লাহকে। ২০১৬ সালে তৈরি এই বাল্ক ক্যারিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। ড্রাফট ১১ মিটারের কিছু বেশি। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেওয়ার আগে এটির নাম ছিল গোল্ডেন হক। মালিকানা পরিবর্তনের পর জাহাজের নামও পরিবর্তন করা হয়। নতুন নাম হয় এমভি আবদুল্লাহ।