পেনশন নিয়ে শুধু শিক্ষকদের টেনশন কেন


hadayet প্রকাশের সময় : জুলাই ৭, ২০২৪, ৩:১৭ পূর্বাহ্ন / ১৮
পেনশন নিয়ে শুধু শিক্ষকদের টেনশন কেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বাত্মক কর্মবিরতির কারণে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা চলছে। গত ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া কর্মবিরতির কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, পরীক্ষা এবং দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্তির কারণে শিক্ষকরা নিজেদের ক্ষতি হওয়ার দাবি করছেন। যদিও পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে -এ ব্যবস্থায় আছে বহু গুণ লাভ। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, শিক্ষকরা যেসব বিষয়ে আন্দোলন করছেন, তা অনেকটাই ভুল বোঝাবুঝি কিংবা সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম পুরোপুরি না বোঝার কারণে। বিদ্যমান সুবিধার চেয়েও প্রত্যয় স্কিমে অন্তত ১২ গুণ বেশি অবসরভাতা পাবেন শিক্ষকরা।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দাবি, বর্তমান ব্যবস্থায় ৬৫ বছর পর পেনশনের সুবিধা ভোগ করেন শিক্ষকরা, প্রত্যয় স্কিমে সেই সুযোগ ৬০ বছরে। এটি একটি শুভঙ্করের ফাঁকি বলে মন একরেন তারা।  যদিও পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করে বয়সসীমা ৬৫ বছর করা হবে প্রত্যয় স্কিমে।

সরকারের সিদ্ধান্ত, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে ১ জুলাই থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি প্রত্যয় স্কিমের অধীনে আসবেন। অর্থাৎ বর্তমানে যারা চাকরিতে আছেন তারা আগের পেনশনের অধীনেই থাকবেন। তবে সব ধরনের স্বশাসিত কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা বিষয়টি মেনে নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাদ সেধেছেন। প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহারের প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে তারা আন্দোলন করছেন।

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী শিক্ষকদের এ আন্দোলন অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেছেন। গতকাল (২ জুলাই) পরিকল্পনা কমিশনে একনেক বৈঠক শেষে তিনি বলেন, প্রত্যয় স্কিম নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা প্রত্যয় স্কিমের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন শিক্ষকরা হিসেবে ভুল করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবি, বর্তমান পেনশন সুবিধায় তাদের বেতনের কোনও টাকা কাটা হয় না। কিন্তু সর্বজনীন পেনশনে তাদের ১০ শতাংশ কাটা হবে। পেনশন কর্তৃপক্ষ এটি স্বীকার করে বলেছে, এখন যে পদ্ধতি সেটি ‘আনফান্ডেড ডিফাইন বেনিফিট সিস্টেম’ আর নতুন যে পদ্ধতি আসছে সেটি হলো ‘ফান্ডেড কন্ট্রিবিউটরি পেনশন সিস্টেম’। যেহেতু এটি কন্ট্রিবিউটরি পেনশন সিস্টেম, তাই যারাই এ পেনশনের আওতায় থাকবেন, তাদের কাছ থেকে টাকা কাটা হবে।

বিবেচনার বিষয় হলো, যে টাকা কাটা হবে তার পরিমাণ কত আর অবসরে যখন যাবেন তার প্রাপ্তি কত। প্রাপ্তি যদি কর্তনের চেয়ে বেশি হয় বা লাভজনক হয় তাহলে সেখানে আপত্তি থাকার কথা নয়। একজন সর্বোচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তার কাছ থেকে কাটা হবে সর্বোচ্চ ৫ হাজার। ৩০ বছরে কাটলে মোট অঙ্ক দাঁড়ায় ১৮ লাখ টাকা। ওই কর্মকর্তা ৩০ বছর চাকরির পর যখন পেনশনে যাবেন তখন প্রতি মাসে পাবেন ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা করে। প্রত্যয় স্কিমের পেনশনার যদি ১৫ বছর ধরে পেনশন পান, সে ক্ষেত্রে তার মোট প্রাপ্তি হবেন ২ কোটি ২৪ লাখ ৩৮ হাজার ৮০০ টাকা, যা তার জমার প্রায় ১২ দশমিক ৫ গুণ। পেনশনার পেনশনে যাওয়ার পর ৩০ বছর জীবিত থাকলে তার জমার প্রায় ২৫ গুণ অর্থ পাবেন।

আন্দোলনরত শিক্ষকরা দাবি করছেন, তারা প্রত্যয় স্কিমে গেলে প্রায় কোটি টাকা ক্ষতি হবে। এ যুক্তির ব্যাখ্যায় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, উনারা কীভাবে হিসাব করেছেন, আমি জানি না। উনারা কী পাবেন তা স্পষ্ট বলা আছে। সেটিকে যদি যোগ-বিয়োগ করে অঙ্ক করেন, তাহলে দেখা যাবে এখন তারা যা পান, কোনো অবস্থাতেই সর্বজনীন পেনশনে তার চেয়ে কম পাবেন না। এখন যারা আছেন তারা আগের সিস্টেমের মধ্যেই আছেন। নতুন সিস্টেমে যারা ১ তারিখ থেকে যোগ দেবেন, তারা এ সুবিধার আওতায় আসবেন। যারা নতুন যোগ দেবেন, তারা দেখেই যোগ দেবেন যে, কী সুবিধা আমি পাচ্ছি।

শিক্ষকদের দাবি, সর্বজনীন পেনশনে তাদের কোনো আনুতোষিক নেই। অথচ বিদ্যমান ব্যবস্থায় তারা আনুতোষিক বাবদ এককালীন ৮০ লাখ ৩০ হাজার টাকা পাচ্ছেন। এ বিষয়টির ব্যাখ্যায় গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আনুতোষিক যোগ করেন, ৩০ বছর যদি বেঁচে থাকেন, ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা করে তিনি কত টাকা পাবেন সেটিও দেখুন। এখন যারা প্রথম গ্রেডে থেকে অবসরে যান তারা প্রাথমিকভাবে পেনশন পান ৩৫ হাজার ১০০ টাকা। তার সঙ্গে পান ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, দুই ঈদে ৩৫ হাজার ১০০ টাকা করে দুটি উৎসব ভাতা, ২০ শতাংশ নববর্ষ ভাতা পান। সব যোগ দিন আর ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা করে ৩০ বছর ধরে পেলে কত পাবেন সেটি যোগ করে দেখেন। প্রাপ্তি যদি বেশি হয় তাহলে আপত্তি থাকার কথা নয়।

চাকরিজীবী ও নমিনি আজীবন পেনশন পান এমন প্রসঙ্গ তুলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বলছেন, প্রত্যয় স্কিমে এমন সুবিধা নেই। এর ব্যাখ্যায় গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘বাস্তবতা হলো নমিনি নয়, শুধু স্ত্রী-স্বামীই পাবেন অথবা তার যদি কোনো প্রতিবন্ধী সন্তান থাকে তাহলে বর্তমান ব্যবস্থায় আজীবন পেনশন পান। আর স্ত্রী-স্বামী ও প্রতিবন্ধী ছাড়া অন্য যে কেউ ১৫ বছরের অবশিষ্ট সময় ভাতা পান। অর্থাৎ ছেলের যদি ২৫ বছরের নিচের বয়স হয়, তাহলে তার বাবা মারা যাওয়ার সময় যদি পাঁচ বছর ভোগ করে যান, ছেলে আর ভোগ করতে পারবেন ১০ বছর। শর্ত হলো, বয়স ২৫ বছরের কম হতে হবে। অর্থাৎ স্ত্রী-স্বামী ও প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পান আর অন্যরা ১৫ বছর পর্যন্ত পান।’

এখানে শিক্ষকরা দাবি করছেন, নমিনি কেন আজীবন পাবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নমিনিরা আজীবন পেনশন পান না, শুধু স্ত্রী-স্বামী ও প্রতিবন্ধী সন্তান ছাড়া। অথচ নতুন সর্বজনীন পেনশনে তার স্ত্রী-স্বামীর যেকোনো স্কিমে ঢোকার সুযোগও আছে। অর্থাৎ বিদ্যমান ব্যবস্থায়ও কোনো সরকারি চাকরিজীবী পেনশনের আওতায় এলেও তার স্ত্রী বা সন্তান কোনো পেনশনের আওতায় থাকেন না।

গোলাম মোস্তফা বলেন, সর্বজনীন পেনশনে যে কেউ নতুন কোনো স্কিমে যুক্ত হতে পারেন। এখন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী যদি মনে করেন তিনিও পেনশন স্কিমে যোগ দেবেন, তিনিও পারবেন। তিনি তার স্বামীর অবসরের পর মারা গেলে তার বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত অবশিষ্ট পেনশনও পাবেন, নিজেরটাও পাবেন। আরেকটি ইস্যু হলো, পেনশন হলো সামাজিক নিরাপত্তা। এর আওতায় প্রত্যেকটি মানুষকে যদি আনা যায়, তাহলে সবাই নিরাপত্তায় থাকবেন।

শিক্ষকদের বছরে পেনশনে ইনক্রিমেন্ট হয় ৫ শতাংশ, তাদের দাবি প্রত্যয় স্কিমে সেটি থাকছে না। পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, ৩৫ হাজার ৫০০ টাকার সঙ্গে ৫ শতাংশ হারে যুক্ত করলেও ৮০ বছর বয়সে এসেও দেখা যাবে ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা তিনি পাচ্ছেন না।

শিক্ষকদের আরেকটি দাবি, অর্জিত ছুটির বিপরীতে যে টাকা পাওয়া যায় সেটি প্রত্যয় স্কিমে নেই। তবে পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে সেটি বহাল আছে।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, কারও অর্জিত ছুটি যদি জমা থাকে তাহলে তিনি অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) পান আর ১৮ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা পান। এ দুটি বিষয় প্রত্যয় স্কিমেও বহাল আছে। প্রজ্ঞাপনে এ দুটি বিষয় উল্লেখ নেই দেখেই, শিক্ষকরা ওই কথা বলছেন।

তিনি বলেন, আমার ছুটি জমা থাকলে আমি সেটি পাব, পেনশনের সঙ্গে সেটিকে লিংক করার কোনো প্রয়োজন নেই।