আগাম বন্যা থেকে হাওরের একমাত্র ফসল বোরো রক্ষার জন্য অস্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ শুরুর নির্ধারিত দিনে মাত্র ২৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার নির্ধারিত দিনে ১২টি উপজেলায় এসব প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। অথচ মোট প্রকল্প ১৯৩টি। সে ক্ষেত্রে প্রাক্কলন শেষ করে চলতি মাসে সব প্রকল্পের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা করছেন হাওর আন্দোলনের নেতারা।কাবিটা নীতিমালা-২০১৭ অনুসারে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রাক্কলন শেষ করে ১৫ ডিসেম্বর বাঁধের কাজ শুরু এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ করার কথা।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), জেলা প্রশাসন ও হাওর বাঁচাও আন্দোলন সূত্রে জানা গেছে, সাতটি হাওর জেলায় ফসল রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেয় সরকার। একসময় দরপত্রপ্রক্রিয়ায় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ হতো। এই প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সরকার ২০১৭ সালে বিশেষ কাবিটা আইন করে কৃষকদের নেতৃত্বে পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) মাধ্যমে বাঁধের কাজ করছে।
নীতিমালা অনুসারে, হাওর এলাকায় গণশুনানি করে কৃষকদের মতামতের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নির্দেশনা রয়েছে। হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতাদের অভিযোগ, পাউবো ও প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট সদস্যদের নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন করিয়ে থাকেন। সঠিক পদ্ধতিতে গণশুনানি না হওয়ায় প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হন। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ ও বেশি বরাদ্দও দেওয়া হয়।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মো. মামুন হাওলাদার জানান, সুনামগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৩৭টি হাওর রয়েছে। এসব হাওরে বেড়িবাঁধ রয়েছে প্রায় এক হাজার ৭১৮ কিলোমিটার। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২৭ প্রকল্প গ্রহণ করে ৫৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মেরামত ও সংস্কার করা হয়েছিল। চলতি মৌসুমে আগাম বন্যা থেকে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ করতে পাউবো প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। গত অক্টোবর মাস থেকে পাউবোর ২৭টি টিম (সার্ভেয়ার ও উপসহকারী প্রকৌশলী) হাওরে গিয়ে প্রিওয়ার্ক (প্রাক্কলন) করেছে।
ওই প্রকৌশলী জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাঁরা এক হাজার ২০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের প্রাক্কলন করেছেন। চলতি বছর অন্তত ৫৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে নির্ধারিত দিনে বৃহস্পতিবার ১২টি উপজেলায় কাজ শুরু হয়েছে। মোট ১৯৩টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
সে ক্ষেত্রে বাকি প্রকল্পের কাজ শুরু ও শেষ করা নিয়ে শঙ্কার বিষয়ে তিনি দাবি করেন, ‘আমরা প্রিওয়ার্কের কাজ শেষ করার পথে। আগামী সপ্তাহেই প্রিওয়ার্ক শেষ হবে। এর মধ্যেই এস্টিমেট তৈরি হচ্ছে। গ্রহণ করা হচ্ছে প্রকল্প। আমাদের স্বস্তি হলো, ১৫ ডিসেম্বর নির্ধারিত দিনে আমরা অন্তত ২০ থেকে ২৫টি কাজ শুরু করতে পেরেছি। আশা করি, বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ এই মাসেই শেষ করা যাবে। ’
দেখার হাওরের কৃষক ও বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা খলিলুর রহমান বলেন, ‘বান্দ যেখানো দেওয়ার কথা হিকানো দেয় না। যেখানো দেয় হিকানো দরকার নাই। আমরার কৃষকরারে কুন্তাত কয় না। মিটিংও করে না। আমরারে কইলে বান্দের কাম বালা অইলনে। ’
দেখার হাওরের লীলপুর গ্রামের কৃষক জয় মামুদ বলেন, ‘পছন্দের কিছু মানুষ দিয়া বান্দ বাইন্দা টেকা মাইরা খাইলায়। হেসে বান্দ ভাইঙ্গা আমরার ফসল মাইর যায়। ’
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, পিআইসি গঠন ও অনুমোদনে জড়িত মধ্যস্বত্বভোগীদের দুর্নীতির কারণে এই পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। গণশুনানি করে মাঠে কমিটি করা হলে প্রকৃত কৃষকরা পিআইসিতে আসতেন এবং বাঁধের কাজে কৃষকদের সমন্বিত অংশগ্রহণ থাকত।
তবে শাল্লা উপজেলা হাওর রক্ষা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু তালেব বলেন, ‘গণশুনানি করে স্বচ্ছতার সঙ্গে পিআইসি গঠন করে আমরা কৃষকদের মতামতের ভিত্তিতে কাজ করছি। ’
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও হাওরের বাঁধ ব্যবস্থাপনা জেলা কমিটির সভাপতি দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, ‘নীতিমালা কঠোরভাবে মানার জন্য মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাউবোর মাঠ পর্যায়ের লোকজন যে প্রিওয়ার্ক করে তাতে অনিয়ম হলে পুনর্বীক্ষণের মাধ্যমে সংশোধন করা হবে। ’
আপনার মতামত লিখুন :