বিশ্ব নদী দিবস : নদী চিনতে ভিন্ন পথে দুই সংস্থা


hadayet প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩, ৫:০২ পূর্বাহ্ন / ৭৬
বিশ্ব নদী দিবস : নদী চিনতে ভিন্ন পথে দুই সংস্থা

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গত মাসের ৯ তারিখে দেশের নদ-নদীর খসড়া তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। তালিকা অনুসারে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৯০৭। অন্যদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডও (পাউবো) নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে একটি প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। পাউবো সূত্র জানিয়েছে, তাদের হিসাবে নদ-নদীর সংখ্যা আট শ থেকে সাড়ে আট শর মধ্যে থাকতে পারে।

দুই সরকারি সংস্থার তালিকায় নদীর সংখ্যা কাছাকাছি হলেও কাজের প্রক্রিয়ায় রয়েছে ভিন্নতা। তবে নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। এ জন্য নদীর সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ ও তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া বিজ্ঞানভিত্তিক হতে হবে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আজ রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী : সংজ্ঞা ও সংখ্যা বিষয়ক সেমিনার’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানে কমিশনের নদ-নদীর তালিকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।

নদী রক্ষা কমিশনের তালিকা

কমিশনের খসড়া অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি নদ-নদী রয়েছে সিলেট বিভাগে, ১৫৭টি। ময়মনসিংহ বিভাগে ১৪৫টি, খুলনায় ১২৮টি, ঢাকায় ১২৫টি, রংপুরে ১২১টি, বরিশালে ১০০টি ও রাজশাহী বিভাগে ৭০টি জীবন্ত নদী রয়েছে।

সবচেয়ে কম নদী চট্টগ্রাম বিভাগে, ৬১টি। একাধিক বিভাগে রয়েছে এমন নদ-নদীর সংখ্যা ৩০। তালিকায় সবচেয়ে বড় নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ইছামতী নদীকে। খুলনা বিভাগের চার জেলার ১০ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীটির দৈর্ঘ্য ৩৩৪ কিলোমিটার।

নদ-নদীর তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পাঁচ হাজারের মতো ভূমি অফিস, পাঁচ শর মতো এসি ল্যান্ড অফিস, ৬৪ জেলা প্রশাসক—সবাই  তালিকা তৈরির সঙ্গে জড়িত।

তিনি জানান, তালিকা তৈরিতে ১৮৮০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত সিএস (ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে) ম্যাপকে মূলভিত্তি ধরা হয়েছে। এ ছাড়া আরএস (রিভিশনাল সার্ভে) ম্যাপের সময় নদী কোথায় ছিল এবং বর্তমানে কোথায় আছে সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

তালিকাটি কমিশনের ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করে এ ব্যাপারে কারো মতামত বা আপত্তি থাকলে তা লিখিতভাবে কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কতগুলো আপত্তি জমা পড়েছে ও নিষ্পত্তি হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি কমিশনের চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, ‘কিছু আপত্তি আমরা নিষ্পত্তি করেছি, কিছু প্রক্রিয়াধীন। যারাই বলুক না কেন, ডিসি সাহেবরা যতক্ষণ না বলবেন এটা নদী, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা নদী না। কারণ পানি দেখলেই অনেকে নদী মনে করে। এনজিওগুলোর মতো হঠাৎ করে বলে দেওয়ার সুযোগ নেই আমাদের।’

মনজুর আহমেদ আরো বলেন, ‘কিছু আপত্তি জমা পড়েছে, যেগুলো বাস্তবতাবিহীন। একজন ১০৫টি আপত্তি দিয়েছে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সেখানে খালকেও নদী বলা হয়েছে। আমরা আপত্তিগুলো ডিসির কাছে পাঠিয়ে দিই। তাঁদের কাছে সব তালিকা, রেকর্ড আছে। তাঁরা যেটা বলেন সেটাই।’

তবে ডিসিদের দিয়ে এই তালিকা করার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে তো নদী হয় না। নদীর কতগুলো বৈজ্ঞানিক তথ্য লাগবে। নদীর সংজ্ঞার ভিত্তি পৃথিবীর সব জায়গায় একই হতে হবে। তা না হলে তো আর বিজ্ঞানের প্রয়োজন নেই, প্রশাসন দিয়ে বিজ্ঞান চালালেই হয়। সিএস ম্যাপ প্রশাসনের জন্য। ব্রিটিশরা জমিদারের এলাকা নির্ধারণ করেছে। প্রশাসনিক কাজের জন্য নদীর এক ধরনের সংজ্ঞা হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতিকে বোঝা তো প্রশাসনিক ব্যাপার হতে পারে না।’

কমিশনের দেওয়া নদীর সংখ্যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা দুই থেকে তিন হাজার হবে। সিলেটের চা-বাগানের দুটি টিলার মধ্যে যে ছড়াটা গেছে, সে ছড়ার যদি একটা নাম থাকে তাহলে তাকেও নদী বলব। এ ক্ষেত্রে  খুব বড় নদী, বড় নদী, মাঝারি নদী, ছোট নদী, অতি ক্ষুদ্র নদী ও ছড়া—এসব শ্রেণিতে ভাগ করে দিতে হবে। প্রতিটি ছড়াই প্রাকৃতিক নদী।’

আইনুন নিশাত বলেন, ‘নদী রক্ষা কমিশন পুরোপুরি ভুল ও দেশকে মিসগাইড করবে তাদের পদ্ধতিতে। তিনজন জার্মান বিশেষজ্ঞ তিন বছর থেকে সুন্দরবনের মধ্যে সাড়ে তিন শর মতো নদী চিহ্নিত করে তার একটা ম্যাপ তৈরি করেছেন। এখন নদী রক্ষা কমিশন এগুলো গ্রহণ না করলে আপনি অনেকগুলোকেই নদী বলতে পারবেন না।’

পাউবোর নদ-নদীর তালিকা ও প্রক্রিয়া

পাউবো সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে পাউবো প্রথম নদ-নদীর সংখ্যা নিরূপণের কাজ শুরু করে। তখন রিমোট সেন্সিং ডাটা পদ্ধতি বা দূর অনুধাবন পদ্ধতির ব্যবহার করে স্যাটেলাইট ইমেজের ওপর ভিত্তি করে নদীগুলো চিহ্নিত করা হয়। সেই ডাটার ওপর ভিত্তি করে প্রথমে ৩১০টি নদী চিহ্নিত করা হয় ২০০৫ সালে। মূলত রিমোট সেন্সিং ডাটা বিশ্লেষণ করে এবং কিছুটা মাঠ পর্যায়ের তথ্য নিয়ে ২০১১ সালে পাউবো ৪০৫টি নদ-নদীর তালিকা প্রকাশ করে।

বর্তমানে এই পদ্ধতির সাহায্যেই এবং মাঠ পর্যায়ের যাচাই-বাছাইকে সমান গুরুত্ব দিয়ে পাউবো নতুন করে নদ-নদীর তালিকা তৈরি করছে। এই প্রকল্পের পরিচালক পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রবীন কুমার বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগেরবারের তুলনায় এবার নদীর সংখ্যা বাড়বে। কাজ প্রায় শেষ। বাকি আছে সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা কেন্দ্রীয় অঞ্চল এবং উপকূলীয় কিছু এলাকা। এখন পর্যন্ত ধারণা করছি, নদ-নদীর সংখ্যা ৮০০ থাকে ৮৫০ হতে পারে। নভেম্বরের মধ্যেই আমরা প্রথম খসড়া প্রকাশ করব এবং এ নিয়ে গণশুনানির আয়োজন করব।’

সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এই কাজে মাঠ পর্যায়ে পাউবোর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। পরামর্শকরা মাঠ পর্যায়ে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে  আলোচনা করে দেখেন কোনটি নদী ও কোনটি নদী নয়। পরবর্তী ধাপে আবার সশরীরে যাচাই করা হয়।

নদী রক্ষা কমিশনের সংজ্ঞায় পুরনো ম্যাপের কথা থাকলেও পাউবোর সংজ্ঞায় তা না থাকা প্রসঙ্গে রবীন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা অবশ্যই পুরনো সিএস, আরএস ম্যাপ বিবেচনায় নিতে পারি। সমস্যা হলো, প্রতিনিয়ত নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। ঐতিহাসিক ম্যাপের ওপর ভিত্তি করে আমরা যদি বর্তমান নদীর সংখ্যা নিরূপণ করার চেষ্টা করি, তাহলে খুব কঠিন একটা বিষয় হবে।’

কমিশন ও পাউবোর সমন্বয়

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য (অবৈতনিক) ও সিইজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, নদী রক্ষা কমিশন ডিসিদের মাধ্যমে নদীর তথ্য সংগ্রহ করেছে ও যাচাই করেছে। এটা একদম চূড়ান্ত কিছু নয়। পাউবোর কাজটা শেষ হলে সেটাও কমিশনের তালিকার সঙ্গে তুলনা করে দেখা হবে। আমার কাছে মনে হয়, দুটি সংস্থারই নদীর সংখ্যা কাছাকাছি হবে। পাউবো ও কমিশনের মধ্যে সমন্বয় করেই এটা করা হবে। আমি বিশ্বাস করি, একটা আরেকটার পরিপূরক হবে।’

পাউবোর প্রকৌশলী রবীন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘নদী রক্ষা কমিশনের ৯০৭ নদীর খসড়া তালিকা এরই মধ্যে আমাদের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছি। কিছু জায়গায় আমাদের দ্বিমত থাকতে পারে। কমিশনের কিছু কিছু নদীর দৈর্ঘ্য দেওয়া আছে একরে ও হেক্টরে। একর ও হেক্টর কখনো নদীর দৈর্ঘ্য হতে পারে না। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করব, মতপার্থক্য দূর করার চেষ্টা করব।’