গত এক দশকে জনস্বাস্থ্য সেবার মানুষের কাছে পৌঁছেছে


bhawalnews প্রকাশের সময় : অক্টোবর ১৩, ২০২৩, ৩:৩০ অপরাহ্ন / ১৪৯
গত এক দশকে জনস্বাস্থ্য সেবার মানুষের কাছে পৌঁছেছে

 

ড. মো: তাজউদ্দিন সিকদার

 

কোন একটি জাতির জনস্বাস্থ্য খাতকে এগিয়ে নিতে দুই ধরনের কর্মপরিকল্পনা দরকার হয়- সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং সমসাময়িক কিংবা তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জনস্বাস্থ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলি ছিল মূলত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে সেটিই স্বাভাবিক ছিল। বঙ্গবন্ধু, সকল নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যসেবার সমান প্রাপ্তি এবং বৈষম্য কমাতে স্বাস্থ্য সেবার জাতীয়করণ করেন, যার সুফল ৫০ বছর ধরে এদেশের মানুষ পেয়ে যাচ্ছে। তিনি সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন যা তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। পাশাপাশি, স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো তৈরি, টিকাদান কর্মসূচি, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনস্বাস্থ্য শিক্ষা, জনস্বাস্থ্যের লোকবল বৃদ্ধি এবং জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে একটি দৃষ্টান্তমূলক যাত্রা শুরু করেছিলেন। এ যাত্রার অংশ হিসেবে ১৯৭৪ সালে জনস্বাস্থ্য শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) প্রতিষ্ঠা করেন।

 

সেই ধারাবাহিকতা থাকলে আরও আগে বাংলাদেশের মানুষ শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা পেতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ১৫ বছরে জনস্বাস্থ্য খাতে জাতির পিতার ছায়াকে অনুসরণ করেছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রম তাৎপর্যগতভাবে একই সাথে সুদূরপ্রসারী এবং সমসাময়িক। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আদলে তিনি কমিউনিটি ক্লিনিক ধারণা প্রবর্তন করেন যা ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবার অংশ। কমিউনিটি ক্লিনিক একটি জনমুখী স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা এবং সারাদেশে গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রসারিত করাই এর লক্ষ্য। এটি জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এই যুগান্তকারী এবং সুদূরপ্রসারী ধারণার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এবার আসা যাক সমসাময়িক কিংবা তাৎক্ষণিক জনস্বাস্থ্য সেবার বিষয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধ করতে এবং দেশে এর প্রভাব প্রশমিত করতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং অবদান রেখেছেন। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে রোল মডেল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির অসামান্য সাফল্যের জন্য, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২০১৯ সালে গ্যাভি ভ্যাকসিন হিরো অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছেন। সুতরাং, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহের দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক, শিশু টিকাদানের সর্বজনীন কভারেজ এবং কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা ও টিকাদানে সাম্প্রতিক সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়েছে। আর এই স্বীকৃতির রূপকার জননেত্রী শেখ হাসিনা।

 

সামগ্রিক স্যানিটেশন, হাইজিন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিশু ও মাতৃমৃত্যু, এইডস ও ম্যালেরিয়া সহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ অর্জনে শতভাগ সফলতা অর্জন করায়, প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরেই বাংলাদেশ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস (এমডিজি) এর লক্ষ্য অর্জন করে। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ এখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ২০৩০ সালের ভিতর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) এর লক্ষ্য অর্জনে।

 

নবজাতক মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মে ২০ এর কম, শিশু মৃত্যুর হার প্রতি জীবিত জন্মে ২১.৫ শতাংশ এবং ৫ বছরের কম বয়সী মৃত্যুর হার ২২-এ নেমে এসেছে। মাতৃমৃত্যুর অনুপাত কমেছে। নারীদের আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৪.১ বছর এবং পুরুষদের জন্য ৭০.৮ বছর হয়েছে। ২০১৩ সালে, বাংলাদেশ এমডিজি লক্ষ্যমাত্রায় ক্ষুধা অর্ধেকে কমানোর জন্য জাতিসংঘের এফএও পুরস্কার পেয়েছে যা দেশের মানুষের পুষ্টির যোগানের স্বয়ংসম্পূর্ণতার বহিঃপ্রকাশ। সরকার খাদ্য নিরাপত্তা ও মান নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে, বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেছে এবং বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছে।

 

২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৮৩..৯ শতাংশ বৈধ পূর্ণ টিকা কভারেজের মধ্যে এসেছে যা ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভ্যাকসিন হিরো অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করেছে। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দ্বারা বাংলাদেশ পোলিও-মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। অবহেলিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে এবং ম্যালেরিয়া রোগ কমাতেও বাংলাদেশ সফল হয়েছে। অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বহুক্ষেত্রীয় কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

 

বাংলাদেশ মানসিক স্বাস্থ্য, অটিজম, এবং প্রতিবন্ধী কল্যাণে বিগত বছরেরগুলোতে বিশেষ নজর দিয়েছে। প্রতিবন্ধী অধিকার আইন এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোটেকশন ট্রাস্ট আইনের মতো আইন রয়েছে। সবচেয়ে বড় সুযোগ যেটা সৃষ্টি করা গেছে তাহলো টেলিমেডিসিন এবং “স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩” কল সেন্টারের মাধ্যমে দেশব্যাপী স্বাস্থ্য সেবা এবং তথ্য প্রদান।

 

গত দেড় দশকে স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতি হয়েছে সরকারের প্রতিশ্রুতি, নীতি, কৌশল, আইন প্রণয়ন এবং তাদের কার্যকর ও সময়োপযোগী বাস্তবায়ন, প্রযুক্তি দ্বারা পরিচালিত ও কার্যকরী সাংগঠনিক নেটওয়ার্কের কারণে। এবং অ-প্রযুক্তিগত স্বাস্থ্য জনশক্তি, সরকারী, বেসরকারী সংস্থাগুলির সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং উন্নয়ন অংশীদারদের সহায়তা; এবং পরিবার পরিকল্পনা, ইমিউনাইজেশন, ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি, যক্ষ্মা, ভিটামিন-এ সহ বিভিন্ন প্রোগ্রামে সামগ্রিকভাবে সক্রিয় অংশগ্রহনের জন্য। এ অগ্রগতি গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- স্বাস্থ্য বীমা, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনে সহনশীলতা অর্জন এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশেষায়িত ভৌত কাঠামো নির্মাণ। এ সরকার ও সরকার প্রধানের নিরলস চেষ্টায় জনস্বাস্থ্যসহ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত আজ এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই উচ্চতা ধারণ করেন বলেই প্রধানমন্ত্রীও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, “আমি অসুস্থ হলে এই দেশেই চিকিৎসা করো, বিদেশে যাওয়ার দরকার নাই”।

 

লেখক- অধ্যাপক, পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়