শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে সমালোচনা এখন তুঙ্গে। সম্প্রতি তাঁকে ‘হয়রানি’ করা হচ্ছে বলে দাবি করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ১২ জন সিনেটর। এই নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর একটি চিঠিও দিয়েছেন তারা। গত ২২ জানুয়ারি ইস্যুকৃত চিঠিটি পড়ে জানা যায়, ড. ইউনূসের প্রতি কথিত ক্রমাগত হয়রানি বন্ধের দাবি জানান তাঁরা। তবে এতে করে একটা জিনিস স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, তাদের এ প্রতিবাদের সঙ্গে কৌশলে বাংলাদেশ ও এর সরকারবিরোধীদের পক্ষ নিয়ে তাদের পক্ষে দাবি জুড়ে দিয়েছেন তারা। তাছাড়াও সরকারবিরোধীদেরকে কৌশলে ‘সরকারের সমালোচক’ তকমা দিয়ে ঐ ১২ সিনেটর বলেছেন, তাদেরকে লক্ষ্য করে আইন ও বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহার বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর পাঠানো এ চিঠিতে মার্কিন সিনেটররা লিখেছেন, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ১৫০টিরও বেশি অপ্রমাণিত মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রমে অনিয়ম হয়েছে।
দেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। যে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে। আর এখানেই রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারিক অপব্যবহার দেখতে পাচ্ছেন ১২ মার্কিন সিনেটর। এবারে ঘোলা জল কিছুটা পরিষ্কার করা হোক!
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এ মামলা সরকার করেনি। বরং শ্রমিকেরাই করেছেন এ মামলা। ছুটি নগদায়ন এবং শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের বিভিন্ন বকেয়া পাওনার দাবিতে ২০১৬ সালে প্রথম মামলা করেন গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ১৪ কর্মী, সরকার নয়। পরে বকেয়া পাওনা চেয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ৯৩টি মামলা করেন তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি গ্রামীণ টেলিকমের বর্তমান কর্মীরা।
ঢাকার শ্রম আদালতে সব মিলিয়ে ১০৭টি মামলা করা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে সরকারকে কোথা থেকে খুঁজে পেলে মার্কিন সিনেটররা? আসলে বাংলাদেশ সরকারকে চাপে রাখার যে মার্কিন খোলামেলা অপচেষ্টা অনেকদিন ধরে করে আসছে; বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে, এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে ১২ মার্কিন সিনেটরের এসব বানোয়াট বিবৃতি সেই মিশনেরই অংশ।
আমাদের কাছে এর যথেষ্ট প্রমাণও রয়েছে।নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ কাগজে কলমেও প্রমাণিত হয়েছে। ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে করা মামলায় গত ১ জানুয়ারি ২০২৪ এ রায় দেন ঢাকার শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা। ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের পরিদর্শক আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে ওই মামলা করেন। লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
এবারে আমরা যদি একটু পিছনে ফিরে তাকাই, তাহলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। ১৯৯৭ সালে কোম্পানি আইন অনুযায়ী গঠিত হয় “গ্রামীণ টেলিকম”। কোম্পানি গঠনের শর্ত মোতাবেক গ্রামীণ টেলিকম তাদের অর্জিত লভ্যাংশের ৫% হারে শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিলে দেওয়ার কথা। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ টেলিকম কোম্পানি “গ্রামীণ ফোনের” ৩৪.২০% শেয়ারের মালিক গ্রামীণ টেলিকম। কিন্তু কোম্পানি আইনের শর্তে গ্রামীণ টেলিকম কোনো শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিল তো গঠন করেইনি, জমাও করেনি লভ্যাংশের ৫%। এ লভ্যাংশের এক দশমাংশ দেওয়ার কথা ছিল জাতীয় শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে। কিন্তু নথি ঘেঁটে দেখা যায় ২০১৩-১৭ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ৫% লভ্যাংশের দশ ভাগের এক ভাগ হিসেবে ৯৪ কোটি ২ লাখ ৯৮ হাজার ৬৮ টাকা জমা দিয়েছে “গ্রামীণ টেলিকম”। ৫ বছরে গ্রামীণ টেলিকমের “শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিলে” দেওয়ার কথা ৯৪০ কোটি টাকার মতো। ১৯৯৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ২৫ বছরে ৫% লভ্যাংশ হিসাবে শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিলে জমা হওয়ার কথা এর ৫ গুণ টাকা। যার মোটামুটি হিসাব দাঁড়ায় ৪৭০০ কোটি টাকা।
২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের পরিদর্শক আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে ওই মামলা করেন। কিন্তু বারবারই মিথ্যাচার করে পার পেয়ে গেছেন তিনি। গ্রামীণ টেলিকম জানিয়েছে, তারা ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২৮ নম্বর ধারায় সৃষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে তারা বলছে ‘নট ফর প্রফিট কোম্পানি। বস্তুত এই আইনের দোহাই দিয়েই তারা বক্তব্যে উল্লেখ করেছে, “কোম্পানি আইন অনুযায়ী যার (গ্রামীণ টেলিকম) লভ্যাংশ বিতরণযোগ্য নয়।”
কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা তলিয়ে দেখলেই তাদের মিথ্যাচারটি ধরা পড়ে। কেননা এই আইনের প্রথম উপধারাতেই আছে, “যদি সরকারের নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রমাণিত হয় যে, সীমিতদায় কোম্পানি হিসাবে গঠিত হওয়ার যোগ্য কোন সমিতি বাণিজ্য, কলা, বিজ্ঞান, ধর্ম, দাতব্য বা অন্য কোন উপযোগিতামূলক উদ্দেশ্যের উন্নয়নকল্পে গঠিত হইয়াছে অথবা গঠিত হইতে যাইতেছে এবং যদি উক্ত সমিতি উহার সম্পূর্ণ মুনাফা বা অন্যবিধ আয় উক্ত উদ্দেশ্যের উন্নতিকল্পে প্রয়োগ করে বা প্রয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং উহার সদস্যগণকে কোন লভ্যাংশ প্রদান নিষিদ্ধ করে, তবে সরকার উহার একজন সচিবের অনুমোদনক্রমে প্রদত্ত লাইসেন্সের মাধ্যমে এই মর্মে নির্দেশ দিতে পারিবে যে, উক্ত সমিতির নামের শেষে “সীমিতদায়” বা “লিমিটেড” শব্দটি যোগ না করিয়াই উহাকে একটি সীমিতদায় কোম্পানি হিসাবে নিবন্ধনকৃত করা হউক, এবং অতঃপর উক্ত সমিতিকে তদনুযায়ী নিবন্ধনকৃত করা যাইতে পারে।” সুতরাং এখানেই প্রমাণিত হয় যে, এ মামলাতে মিথ্যাচার করা হয়েছে। এবারে আসি চাকরি স্থায়ীকরণ না করা প্রসঙ্গে।
ড. ইউনুসের পক্ষে থেকে বলা হয়েছে, “গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়।” তারা যুক্তি দিয়ে বলেছে, যেহেতু গ্রামীণ টেলিকমের সকল ব্যবসায়িক কার্যক্রম চুক্তিভিত্তিক, তাই তাদের নিয়োগও চুক্তিভিত্তিক। তবে আইন অনুযায়ী তাদের দাতব্য বা উন্নয়নমূলক কাজ করার কথা। অর্থাৎ তার নিজের কথাতেই নিজের কাজের অসামঞ্জস্য ফুটে উঠেছে। গ্রামীণ টেলিকম তাদের বক্তব্যে বলেছে, তারা কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে স্থায়ী করে না, বরং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়, এ দাবিটি মিথ্যা ও আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিমূলক।
শ্রমিক ঠকানোর জন্য তারা শিখণ্ডী হিসেবে শ্রম আইন ২০০৬ এর চতুর্থ ধারার কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু এ আইন তারা মানেনি। একটু তলিয়ে দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়। শ্রম আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী শ্রমিকের যে শ্রেণিবিন্যাস দেওয়া আছে, সেখানে ‘চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক’ বলে কোনো কথা নেই, কোনো শ্রেণিবিন্যাসও নেই। এ আইনের ৫, ৬ ও ৭ ধারায় বিভিন্ন শ্রেণির শ্রমিকের কাজের বণ্টন দেওয়া আছে। গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালা যে শ্রমিকদের কীভাবে বঞ্চিত করছে, এটাই তার স্পষ্ট প্রমাণ।
এবারে আসি লভ্যাংশের টাকার ব্যাপারে। রিভিউ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকমের আর্থিক প্রবাহ থেকে দেখা যাচ্ছে- এই টাকা প্রথমে গেছে ‘গ্রামীণ উদ্যোগ’ নামের প্রতিষ্ঠানে। সেখান থেকে গেছে ‘গণশিক্ষা-গ্রামীণ টেক্সটাইল মিল’ ও ‘গ্রামীণ শিক্ষা’ নামক প্রতিষ্ঠানে। আরও টাকা গেছে ‘গ্রামীণ সলিউশনস লিমিটেড’, ‘গ্রামীণ আইটি পার্ক লিমিটেড’, ‘গ্রামীণ-ডানো ফুড লিমিটেড’, ‘গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড’, ‘গ্রামীণ ফেব্রিকস ও ফ্যাশন লিমিটেড’ ও ‘গ্রামীণফোন’ নামক কোম্পানিতে। টাকা গেছে ‘গ্রামীণ হেলথ কেয়ার সার্ভিস লিমিটেডে’।
এখান থেকে টাকা গেছে ‘গ্রামীণ ভ্যেয়োলা ওয়াটার লিমিটেডে’। টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে ‘গ্রামীণ হেলথ কেয়ার ট্রাস্ট লিমিটেডে। এর টাকা আবার বিনিয়োগ হয়েছে ‘বিএএসএফ গ্রামীণ লিমিটেডে’। টাকা গেছে ‘গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্ট’ নামক কোম্পানিতে। এর টাকা আবার গেছে ‘গ্রামীণ মৎস্য ও পশু সম্পদ ফাউন্ডেশনে’।
অর্থাৎ কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা ভঙ্গ করে তারা এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে (অনুদান নয় কিন্তু)।প্রতিটি কোম্পানি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, কারণ তাদের অডিট প্রতিবেদনে আরও বাণিজ্যিক বিনিয়োগের তথ্য আছে। অর্থাৎ যে আইনের দোহাই দিয়ে তারা শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করলো না, সেই একই আইন ভঙ্গ করে তারা বাণিজ্যিক বিনিয়োগ করলো। এমনকি শ্রম আইন লঙ্ঘনের সকল অভিযোগ, মামলা ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং রায় নিজের পক্ষে আনার জন্য নীল নকশা তৈরি করে। পাশাপাশি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে দালালের আশ্রয় নেয়।
এবারে আমার প্রশ্ন হচ্ছে,এতকিছুর পরেও কীভাবে মার্কিন সিনেটররা দাবি করে যে ড. ইউনূসের সাথে অন্যায় হচ্ছে। এবং সে ইস্যুতে দেশের সরকার বরাবর চিঠি পাঠাচ্ছে? বরং এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ন্যায়ের নাম করে তারা অজ্ঞাতভাবেই সরকার বিরোধী কাজ করছে যা আপাত দৃষ্টিতে সরকারবিরোধীদেরকেই সমর্থন করছে।
আবু জাফর মিয়া
সহযোগী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
আপনার মতামত লিখুন :