মুক্তিযুদ্ধ থেকে উন্নয়নের শিখরে বাংলাদেশ, সুমিত কুমার পাল


hadayet প্রকাশের সময় : মার্চ ৩, ২০২৪, ৩:২০ পূর্বাহ্ন / ১১২
মুক্তিযুদ্ধ থেকে উন্নয়নের শিখরে বাংলাদেশ, সুমিত কুমার পাল

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের গর্বের ইতিহাস, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের নামের সাথে যে নামটি চলে আসা অবধারিত সেটি হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতিকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ব দেখিয়েছেন তিনি। আজ তারই কন্যা শেখ হাসিনার বদৌলতে সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়! কিন্তু এই বাঙালিকে একটি হীন, দুর্বলচিত্ত জাতি হিসেবে পরিচয় করিয়েছে ব্রিটিশরা। আজও এই পরিচয়ের কালিমায় সিক্ত হয়ে বাঙালি শাসিত হয়ে আসছে। শাসনের ভার যথার্থ অর্থে বাঙালি কোনো দিন পায়নি। একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর তর্জনী উঁচু করে বাঙালি যে মাথা নোয়াবার পাত্র নয়, তা প্রমাণ করেছেন।

ইতিহাস বলছে, গুপ্তযুগের পূর্বে বাঙালির কোনো পরিচয় ছিল না। ইতিহাসে শশাঙ্ক ও গোপাল নামক দুই স্বাধীন চেতা রাজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু তারা স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করেছেন ইতিহাসে এমন প্রমাণ নেই। বাংলাদেশের ইতিহাস নানা জটিলতার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ইংরেজ এসেছে। ইংরেজরা ছিল সুচতুর জাতি। ইংরেজ তার শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করেছে। জন্ম দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার। যে সাম্প্রদায়িকতায় নানা দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষে মানুষে বিশৃঙ্খলায় মেতেছে। অর্থাৎ বাঙালি নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানত না। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছাড়লে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে দিয়ে যায়। জন্ম নেয় পাকিস্তান নামের এক বিষবৃক্ষ। চরম ধর্মীয় মনোভাব নিয়ে পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিদের শাসনে প্রবৃত্ত হয়। বাঙালিরা হলো পাকিস্তানি। বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবনবোধ- সব হবে পাকিস্তানি শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া ভাষাকেন্দ্রিক। পাকিস্তানের শাসকরা বাংলার ভাষাকে উর্দু ভাষায় রূপান্তরিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা টিকে থাকতে পারল না। বাঙালিকে স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে যিনি নেতৃত্ব দিলেন তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মুজিবের অস্তিত্ব আর ভালোবাসা না থাকলে বাঙালি জাতি আজ বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারত না। বাঙালি জাতি হতে পারত না। পারত না ইতিহাসের গতিধারা বদলে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে। বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে প্রকৃত বাঙালি হতে শিক্ষা দিয়েছেন। রেসকোর্সের মাঠে ভাষণে বলেছেন- ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ।’ আমরা প্রত্যাশা করি, তার এই আদর্শ প্রতিটি বাঙালি জীবনে প্রতিফলিত হবে। অসাম্প্রদায়িক জীবনযাপন করব।

আজ রাজনীতির স্বার্থে অনেকেই জাতির পিতার আদর্শকে ম্লান করতে চায়। আমরা বাঙালি অনেক গ্লানি কাটিয়ে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছি। শেখ মুজিব না হলে আমাদের এই স্বাধীনতা সম্ভব হতো না। তিনিই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, তিনিই আমাদের আদর্শ, তিনিই আমাদের অনুপ্রেরণা। যেমন একাত্তরে ছিলেন এখন আছেন! স্বাধীনতার জন্য দরকার আদর্শ, দরকার ত্যাগ ও তপস্যা।

স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয়, যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এ রাতেই তাঁকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানিরা। সে সময় তাঁর ডাকে বাঙালি জাতি তাদের চিরকালীন দাসত্ব ঘুচিয়ে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিল এবং লাখো প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা সেদিন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষা করেছিল। ক্ষমতার বদলে দিয়েছিল বুলেট আর কামানের গোলা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশের মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাকে শেষ করে দিতে বর্বর হত্যাকান্ডে মেতে ওঠে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগমুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পর তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী ৩০ লাখ শহীদকে, সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের; স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও চার জাতীয় নেতাকে এবং ১৫ আগস্টের কালরাতের সেই শহীদদের যাদের প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। মূলত তা রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১৯৫২ সালে যুব সম্প্রদায়, বিশেষত ছাত্ররা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তরুণ ও উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। বাঙালি জনগণ এ সিদ্ধান্তকে তাদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা মিছিল নিয়ে রাস্তায় বের হলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে কয়েক ছাত্র ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়। আবুল বরকত, আবদুস সালাম, আবদুল জববার, রফিক উদ্দিন আহমদসহ অনেক নাম না জানা ব্যক্তি শহীদ হন। পরে গণঅভ্যুত্থান এমন ব্যাপক রূপ নিয়েছিল যে, সরকার নতি স্বীকার করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতিদানে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি শাসকচক্র কর্তৃক সাংস্কৃতিক অন্তর্ঘাতের বিরুদ্ধে এটি ছিল বাঙালিদের প্রথম উল্লেখযোগ্য বিজয়।

স্বাধীনতা এমন জিনিস নয়, যা কখনো বিনা ত্যাগ ও তপস্যায় অর্জন করা যায়। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি অনেক ত্যাগ ও তপস্যার বিনিময়ে। আমাদের এই ত্যাগ ও তপস্যার নায়ক শেখ মুজিব। বাঙালি আজ এই দুর্জয় বীরের নেতৃত্বে স্বাধীনতা পেয়েছে এবং এই দেশের নামকরণ হয়েছে বাংলাদেশ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার প্রিয় সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছাকে এক দল কুলাঙ্গার সেনা কর্মকর্তা রাতের আঁধারে আক্রমণ চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়া এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়াদের মধ্যে রয়েছেন দশ বছরের শেখ রাসেল, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল এবং শেখ জামালের স্ত্রী রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ নাসের, ভাতিজা শেখ ফজলুল হক মণি এবং তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি। ওই সময় বিদেশে থাকার কারণে শুধুমাত্র তার কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা ওয়াজেদ এবং শেখ রেহানা প্রাণে রক্ষা পান।

শেখ মুজিবের সুচিন্তা থেকে আজকের বাঙালিরও শেখার আছে- উল্লেখ করে ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সম্প্রতি বলেছেন- তাকে ‘বাংলাদেশের জনক’ বা বঙ্গবন্ধু বলাটা নিতান্তই কম বলা। তিনি এর চেয়ে বড় কোনো অভিধা এবং নাম কিনতে চাননি। মানুষ তাকে অন্তর থেকে ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা ভেবেছিল ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে দেবে-তা হয়নি। বাঙালি তাকে ভোলেনি। মুজিব আছেন বাঙলায়, আমাদের আদর্শে, আমাদের অনুপ্রেরণা ও আমাদের চেতনার প্রতীক মহাপুরুষ হয়ে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।