কোটা নিয়ে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন কতটুকু যৌক্তিক?


hadayet প্রকাশের সময় : জুন ১০, ২০২৪, ৩:০১ পূর্বাহ্ন / ৪৪
কোটা নিয়ে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন কতটুকু যৌক্তিক?

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে দুটি গ্রেডে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। গত বুধবার (৫ জুন) এ সংক্রান্ত একটি রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ এ রায় দেয়। রায়ের পর পরই তা প্রত্যাখ্যান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন একদল শিক্ষার্থী। উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল না করে সরাসরি আন্দোলনে গিয়ে প্রতিবাদ জানানো নিয়ে চলছে তুমুল সমালোচনা। আইনজীবীদের মতে, এই ধরনের ঘটনা আদালত অবমাননার সামিল।

২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার প্রচলন ছিল। তবে ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে সরকার ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা ওই পরিপত্রে বলা হয়, নবম গ্রেড (আগের প্রথম শ্রেণি) এবং দশম থেকে ১৩তম গ্রেডের (আগের দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হল। এখন থেকে মেধারভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতই বহাল থাকবে বলে ওই পরিপত্রে বলা হয়।

সরকারি নিয়োগের দুই শ্রেণিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল, সেটি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে উচ্চ আদালত। ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। সে রিটের শুনানি নিয়ে ওই ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। সর্বশেষ গত বুধবার সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। ওই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার ফলে এখন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়ায় আর কোনো বাধা থাকল না।

রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মো. সাইফুজ্জামান বলেন, রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর রুল দেয় হাই কোর্ট। রুলে ওই পরিপত্র কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট ঘোষণা করে রায় দেওয়া হল।

এ রায়ের পর থেকে কোটা বাতিলের দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু করেছেন একদল শিক্ষার্থী। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা কোনো দেশের স্বাভাবিক শিক্ষাব্যবস্থা হতে পারে না। হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহালের রায় দিয়েছে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানান। তারা দেশের সূর্যসন্তান। তাই বলে তাদের সন্তান এমনকি নাতি-নাতনিরা পরিশ্রম না করেই কোটায় চাকরিতে যোগ দেবে, এটা মানেন না তারা।

রায়ে অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে ওই শিক্ষার্থীরা বলেন, এটা তাদের অধিকারের লড়াই। মেধাবীরা পরিশ্রম করে চাকরি পাবেন, কোটায় নয়।

আবার একদল শিক্ষার্থী বলছে, কোটা বাতিলের দাবিতে কখনো আন্দোলন হয়নি। এর আগে আন্দোলন হয়েছে কোটা সংস্কার করার দাবিতে। সরকার দাবির মুখে কোটা বাতিল করে দিয়েছে। তবে আদালতের রায়ের ফলে কোটা ব্যবস্থা ফিরে আসায় তা নিয়ে আইনি লড়াই করার পক্ষে মত দেন তারা।

ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, এটা যেহেতু আদালতের বিষয়, আদালতের বিষয় আইনগতভাবেই সমাধান করা উচিত। আদালত কোনো সিদ্ধান্ত নিলে দেশের নাগরিক হিসেবে সে ব্যাপারে মন্তব্য করা উচিত নয়। আমার মনে হয়, এর বিপক্ষে যদি কারও বক্তব্য থাকে সেটা আইনগতভাবেই দেখতে হবে।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির অবৈধ ও অযৌক্তিক আন্দোলনের কারণে সরকার ১ম ও ২য় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সংবিধান পরিপন্থি একটি পরিপত্র জারি করেছিল। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জামাত-শিবিরের ক্যাডাররা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ঢাবির ভিসির বাসভবনে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে কোটা বাতিলের অবৈধ আন্দোলন করেছিল।

এদিকে রবিবার (৯ জুন) হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ আবেদন করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। এ বিষয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সাইফুল আলম জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত, এতে হাইকোর্ট কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।

অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে এই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। সেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ তাদের সন্তানদের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক কোটার যে বিষয়টি ছিল, সেটা যথাযথ প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় অমনোযোগিতা ও অমান্য করা হচ্ছে। সে বিষয়ে উচ্চ আদালত থেকে একটি নির্দেশনা এসেছিল। আমরা সবাইকে অনুরোধ জানাব উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি ও নির্দেশনার প্রতি সবাই যথাযথভাবে সম্মান দেখাবেন।

তিনি আরও বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, মুক্তিযুদ্ধের এত সময় পরে এসেও তাদের সন্তানদের জন্য রাখা কোটা প্রশ্নে কিছু মানুষের এত উষ্মা। দেশ যারা স্বাধীন করে দিয়েছেন তাদের সন্তানদের দিয়ে তারা যদি দ্বিতীয়বার প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে এটা কোনোভাবে কাম্য নয়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মঞ্জিল মোরশেদের মতে, উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা আদালত অবমাননার সামিল।