হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাম্য, মৈত্রী ও শোষণ মুক্তির মহান মন্ত্রে রচিত এই বাংলাদেশ। একটি শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্নে অপশক্তি ও দুর্নীতিকে নির্মূল করতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সোচ্চার এবং দৃঢ় অবস্থানে।
দুর্নীতির সঙ্গে যে মূলত শিক্ষিত সমাজের ক্ষুদ্রতম একটি অংশ জড়িত, সে বিষয়টি বঙ্গবন্ধু বহুবার উচ্চারণ করেছেন । দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু তাঁর অবস্থানও সুস্পষ্ট করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার অবস্থান তাঁর পিতার মতো আপসহীন ও অকুতোভয়। প্রধানমন্ত্রী বরাবরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে ভয় পাননি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, তাঁর রাজনীতি নিজের জন্য নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নেই তাঁর এই পথচলা। বঙ্গবন্ধু কন্যা বরাবরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সুস্পষ্ট করেছেন।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি ও তার দোসরদের আমলে হাওয়া ভবনকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। তারা দেশকে পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছিল, চারবার একক ও একবার আফ্রিকার একটি দেশের সাথে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছিল। তাদের আমলে আমরা দুর্নীতির স্রষ্টাদের মুখে দুর্নীতি বিরোধী বয়ান শুনে শুনে হতবাক হয়েছিলাম।
জনগণের ভালোবাসা ও বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ২০০৮ সালে ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরপরই বিএনপি–জামায়াত আমলের রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, দুঃশাসন ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। এই যুদ্ধ সহজ ছিল না। প্রতিটি পদক্ষেপেই চ্যালেঞ্জ ছিল । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর শাসনামলে দুর্নীতি নির্মূল করতে গিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা দমে যাননি। তাঁর ভাষায়, তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পান না। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে প্রণয়ন করেছিলেন সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’, ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’, ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯’, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯’, ‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১’মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’, ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২’। এসব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের সর্বস্তর দুর্নীতিমুক্ত করার কাজ শুরু করেছিলেন। যার ফল স্বরূপ, টিআই’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ ছিল ১৪তম অবস্থানে। ২০১৩ সালে ছিল ১৬তম এবং ২০১২ সালে ছিল ১৩তম স্থানে।
২০১৪ বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারেও দুর্নীতি প্রতিরোধে, আইনি, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ জোরদার করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা । দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করেছেন। ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি, ঘুষ, অনোপার্জিত আয়, কালো টাকা, ও পেশিশক্তি-দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে। বাদ যায়নি নিজ দলের মন্ত্রী কিংবা নেতারাও। ছাড় দেননি দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তি-বিশেষকেও। বিশ্ব মোড়লদের রক্তচক্ষু ও পরাশক্তির দৌড়ঝাঁপ কোনকিছুই টলাতে পারেনি শেখ হাসিনার নৈতিক অবস্থানকে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণে শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থানের কথা স্পষ্ট করে পুনর্ব্যক্ত করেন। ২০১৯ সালে ক্যাসিনোকাণ্ডে যুবলীগে শুদ্ধি অভিযান চালান শেখ হাসিনা। অনিয়মের অভিযোগে ছাড় পাননি সেসময়ের ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। কোভিড-১৯ নিয়ে প্রতারণা ও দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে শাস্তির আওতায় এনে করোনা মহামারি মোকাবিলা করেছেন সাফল্যের সাথে।
২০২০ সালে একাদশ সংসদের অষ্টম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া অব্যাহত থাকবে’। তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িতদের দলীয় পরিচয় বিবেচনা না করেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করে। ‘কে কোন দলের সেটি (আমাদের কাছে) বড় কথা নয়।’
২০২৪-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের কথা বলেছেন। টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করেই গত ১৫ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে আবারো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম সহ্য না করার কঠোর অবস্থানের জানান দেন।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন। এর ধারাবাহিকতায় গত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘সচিব সভায়’ পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধে খুবই কঠোর ব্যবস্থা নিতে সচিবদের প্রতি নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্সের’ কথা সচিবদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নয়। দুর্নীতি নিরসন ও প্রতিরোধের জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও সচিবদেরও দায়িত্ব আছে।’
আমরা মনে করি দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই লৌহমানবী রূপ সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক মানবাধিকার, আইনের শাসন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে দেশের দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অশিক্ষা, বঞ্চনা ও বেকারত্ব দূর হবে। একটি সমৃদ্ধ, শোষণমুক্ত ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। আর সেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য পরাকৌশল হলো দুর্নীতি দমন ।
তবে আমাদের মনে রাখা দরকার শুধুমাত্র আইন করে দুর্নীতিকে দমন করা সম্ভব নয়, তার জন্য সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তোলতে হবে। সুশীল সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন, নাগরিক গোষ্ঠী ও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে উঠতে পারে দুর্নীতি বিরোধী একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন ।
সর্বোপরি, অনিয়ম ও দুর্নীতি যে করুক না কেন ব্যক্তি পরিচয় ও অবস্থান নির্বিশেষে প্রধানমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন- এ প্রত্যাশা দেশপ্রেমিক সকল জনগণের। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতন্ত্র ও উন্নয়নের গতিপথে ফিরিয়ে আনতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরন্তর লড়াই করে চলেছেন। আমার বিশ্বাস, দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ দুর্নীতি বিরোধী এই যুদ্ধে শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করবেন ।
অধ্যাপক ড. আশুতোষ দাশ
জেনেটিক্স ও এনিম্যাল ব্রিডিং বিভাগ এবং সহসভাপতি, প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরাম, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মতামত লিখুন :