আধিপত্য বিস্তার, দলীয় অন্তঃকোন্দল আর ক্ষমতার লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের শত্রু এখন আওয়ামী লীগই। গত ছয় মাসে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুনের শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ৪০ জন নেতা-কর্মী। এ তালিকায় রয়েছেন দলীয় এমপি থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মী। অভ্যন্তরীণ বিরোধের বাইরেও তুচ্ছ কারণে খুনের শিকার হতে হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের আরও কমপক্ষে ১২ নেতা-কর্মীকে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের নিজস্ব অনুসন্ধান ও প্রকাশিত সংবাদ এবং মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিট থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এতসংখ্যক নেতা-কর্মী খুন হওয়ার বিষয়টি দলের নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুললেও খুনের এ মিছিল থামছে না। কয়েক দিন পরপর দেশের কোথাও না কোথাও দলীয় কোন্দলে নিহত হচ্ছেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে সৃষ্ট বিরোধ সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। খুন হচ্ছেন আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আর এসব খুনের অভিযোগ উঠছে ক্ষমতাসীন দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। গ্রেফতারও হচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। এ নিয়ে চিন্তিত দলের হাইকমান্ড। ফলে দলের সাংগঠনিক ভিত্তিও দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা ব্যক্তিগত নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ফলে দলটির মধ্যে কোন্দল বাড়ছে। আর এই কোন্দল থেকেই হচ্ছে খুনোখুনি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাওয়া-না-পাওয়া থেকে ক্ষোভ ও মতবিরোধ এবং অন্তর্কলহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ।
চলতি বছরে সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকান্ড হচ্ছে ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের। গত ১১ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। ২২ মে সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, নিউটাউনের এক বাড়িতে খুন হয়েছেন এমপি আনার। এর পরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ভারতের পুলিশের বরাত দিয়ে হত্যাকান্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এ ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুসহ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এবং আনারের ঘনিষ্ঠজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, এটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। হত্যার পেছনের কারণ খুঁজতে মাঠে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। গত ২৭ জুন রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রানীহাটিতে গুলি ও বোমা হামলা করে নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালামকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময় হরিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক আবদুল মতিনকেও হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একই দিনে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কাশিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক সুরুজ মিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তির সঙ্গে এলাকার সালাউদ্দিন সালু ও হীরার সঙ্গে বিরোধ ছিল।
গত ২২ জুন রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় পৌর সেবা বৃদ্ধি ও কর কমানোর দাবিতে মানববন্ধনে হামলা চালিয়ে জখম করা হয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলকে। পৌর মেয়র আক্কাস আলী ও তার অনুসারীরা এই হামলায় জড়িত বলে অভিযোগ। আহত বাবুলকে ২৩ জুন অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপর আইসিইউতে নেওয়া হয়। গত ২৬ জুন মারা যান বাবুল। এ ঘটনায় স্থানীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করা হচ্ছে।
গত ৮ জুন রাতে পাবনা সদর উপজেলার গয়েশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি জহিরুল ইসলাম বাবু শেখকে মুখ ঢাকা অস্ত্রধারীরা গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায়। বাবু শেখ মনোহপুর গ্রামের মৃত আজাহার শেখের ছেলে।
গত ৫ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে এক ছাত্রলীগ নেতা আরেক ছাত্রলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করে। উপজেলা সদরের ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর কলেজ পাড়া হোস্টেল মোড়ে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে আনন্দ মিছিলে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ছাত্রলীগ নেতা আয়েশ রহমান ইজাজ। অভিযুক্ত জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হাসাল আল ফারাবি। ৫ জুন কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায় এক যুবলীগ নেতা খুন হয়েছেন। উপজেলার বাড়েরা ইউনিয়নের গড়ামারা গ্রামের আক্কাস আলীর বাড়িতে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। একই দিন মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাব খান খুন হন। এ সময় নিহতের ছেলে জনি খান আহত হন। দুপুরে উপজেলা দীঘিরপাড় বাজারের পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
গত ২১ জুন সুজানগর উপজেলা নির্বাচনি বিরোধের জের ধরে যুবলীগ নেতা আল আমিন মিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী শাহিনুজ্জামান শাহীনের সমর্থক ছিলেন।
গত ২৭ জুন পাবনার সুজানগর উপজেলা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষে হামলায় গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মোজাহার বিশ্বাস নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী মারা যান। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াহাবের কর্মী ছিলেন বলে জানা গেছে।
গত ৭ মে কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর বাজারে খুন হন বাহারছড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহরিয়ার মুরাদ। ১২ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরে চন্দ্রগঞ্জে দলীয় পদ বাণিজ্যের আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ নেতা এম সজীব খুন হন। নিহত ছাত্রলীগ নেতার স্বজনদের দাবি, ছাত্রলীগের পদের জন্য চন্দ্রগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক কাজী মামুনুর রশিদ বাবুলের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন ছিল নিহত সজীবের। এ নিয়ে ওই সময়ে বিরোধ দেখা যায়। এর জের ধরে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
গত ২৯ মার্চ ছাত্রলীগ নেতা মুখলেস উদ্দিন ভুইয়ার ছোটবেলার বন্ধু মিজান শেখ কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ নেতা মুখলেসকে। হত্যা করে তার লাশ সিমেন্টের ব্লকে বেঁধে নরসুন্দা নদীতে ডুবিয়ে দেয়। গত ৭ জানুয়ারি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নে নৌকার মিছিল করে বাড়ি ফেরার পথে ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কাজী জিয়াউল ইসলাম ফুয়াদকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ৯ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রাম শহরে পৌর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ শরিফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। ১৫ জানুয়ারি ঝালকাঠির পৌর এলাকার ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি রিপন মল্লিকের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। ১৬ এপ্রিল ঠিকাদারি কাজের টাকা ভাগবাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে নাটোর পৌরসভার কাউন্সিলর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগের নেতাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে প্রতিপক্ষের চাপাতির আঘাতে শিহাব হোসেন শিশির নামে একজন নিহত হন। ৩০ এপ্রিল নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর পৌর শহরের আজিমনগর রেলস্টেশন এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা মনজুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই আওয়ামী লীগ নেতা ২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর পৌর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহারুল ইসলাম হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)-এর তথ্যমতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে নৌকার প্রার্থী বনাম স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ২১০টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এতে ১ হাজার ৭৪৮ জন আহত হন এবং ১৩ জন মারা গেছেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতায় ছয়জন মারা গেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :